ধারাবাহিক গদ্য
রাংতায় আগুন ধরাও
১। একটি পেইনটিং এর জন্ম ও মৃত্যু
রাংতায় আগুন ধরিয়ে দাও।
ধারালো চাঁদের মত, মাটির গোপন আঁধারে।
একটা গোটা জীবন কাটাও এভাবেই
একটা সম্পূর্ণ জীবন
রাংতায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে...
যাতে তোমার আত্মাকে
কেউ পোড়াতে না পারে ।
গত কয়েকদিন ধরে এই ছবিটার কথা ভেবেছি। সাদা ক্যানভাসের ওপর যখন মাস্কিং টেপ লাগাচ্ছিলাম, প্রথমে আড়াআড়ি একটু চওড়া করে ক্যানভাসের মাঝখান অবধি, তারপর কয়েকটা সরু টেপ লম্বালম্বি সেটার নিচের থেকে ক্যানভাসের শেষ মাথায়, তখনি কয়েকটা ভাঙা টিনের চালের ছাদ আবছা ভাবে দানা বাঁধছিল মনে। একটি দৃশ্য তার বাস্তবতা পেরিয়ে দিন ভাঙে, রাত পেরোয়, তার পর কখন কী ভাবে স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ে তার স্পষ্ট উত্তর কিছু নেই। মাইমেসিস যাই প্রমাণ করতে চাক না কেন ঘটনা হচ্ছে দৃশ্য ও তার প্রতিরূপ এর মাঝখানে অনেক ফাটল, অনেক ক্ষত, অনেক ছেদ, সময়ের নিয়মেই দেখা দিতে থাকে। অন্ধকার, বিপন্ন বাতাস, দেবদারু পাতাদের নিস্তব্ধতা লেগে থাকে তাদের ফাঁকে ফোকরে।
চালসায় দেখেছিলাম সে দৃশ্য। টিনের চালের বাড়িঘরের আড়ালে পাহাড়ের আবছা রেখা, তার মাথায় ধূসর হলুদ চাঁদ জ্যোৎস্নার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে।
ছবিতে মাস্কিং টেপ লাগালাম, সাদা স্পেস ছাড়লাম, কিন্তু তখনো জানিনা কী হয়ে উঠছে। তবু এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চলা এটাই ভাল লাগে আমার। হাঁটতে হাঁটতে সব কিছু ফুটে উঠবে ক্রমশ । মাস্কিং টেপ আর তার পাশের সাদা জায়গাটার ওপর প্রুশিয়ান ব্লু মেশানো কালো রঙ লেপে দিলাম এবার। চকচক করে উঠছিল জায়গাটা। যেন এবার ও কিছু বলতে চায়। যেন অতীতের কোন দিনকে একই সাথে দু হাত দিয়ে ঠেলে আটকে রাখতে চাইছে, আর একই সাথে চাইছে, তার নিজের কালোকে ছিঁড়ে খুঁড়ে সেটা বেরিয়ে আসুক সামনে। ক্যানভাসের বাকি সাদা অংশ তখনও বোবা, অভিব্যাক্তিহীন।
তিনদিন আগে ছবিটা যখন শুরু করেছিলাম তখন রাত দেড়টা। আর আজ সকাল দশটায় দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের ওপর জানলা দিয়ে রোদ্দুর এসে পরেছে। কালো রঙয়ের ওপর রোদের আলো প্রতিফলিত হয়ে জায়গাগুলো চকচক করছে ফের। এখন যেন কথা বলার জন্যে প্রস্তুত তারা। ঠিক হঠাৎ রাস্তায় পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলে ঠোঁটে খেলে যাওয়া মুগ্ধ হাসির মত হাসি লেগে আছে তাদের চোখে মুখে।
অথচ সেদিন রাতে মাস্কিং টেপগুলো নিয়ে আর নাড়া চাড়া করিনি। বুকের ওপর কালো রঙ নিয়ে তারা ওভাবেই পড়ে ছিল সারারাত। তিন পেগ রাম খেয়েছিলাম সে রাতে। ক্যানভাসের সাদা স্পেস ছেড়ে রেখেছিলাম যেমন ছিল তারা সেভাবেই। রঙ, বর্ণ, নির্বাচন করবার আমি তো কেউ নই। ওরাই জানে ওরা কোন রঙএ প্রকাশ পেতে চায়। রাত চারটে অবধি চুপচাপ বসে ছিলাম ছবিটার দিকে তাকিয়ে। ঠিক কি যে ভাবছিলাম এখন আর মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, ‘ভাঙাচোরা’ শব্দটা কী ভাবে যেন গেঁথে গিয়েছিল মাথার ভেতরে।
একটা কাল্পনিক সংলাপ মনে আসছে এখন।
- বিলি জোয়েল এর গান শুনেছো?
কফির কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে জিগেস করি তাকে।
- পিয়ানোম্যান?
- হ্যাঁ।
- ওখানে একটা লাইন আছে অনেকটা এইরকম।
- “এখন তারা একটা ড্রিংক শেয়ার করে নিচ্ছে যার নাম ‘একাকীত্ব’”
- “ তবে একা একা পান করার থেকে সেটা খাওয়া অনেক ভাল”। এটা তার পরের লাইন, তাই তো?
বাইরে থেকে রোদ্দুর এসে ক্যানভাসের নিচের দিকটায় প্রায় ফ্যাকাশে একটা আলো তৈরি করেছে। কালো রঙএর মাস্কিং টেপ এর ওপর কিছুটা সাদা কিছুটা ক্রোমিয়াম ইয়ালো ছড়িয়ে দিই। তারা বাইরেও কিছুটা ছড়িয়ে যায়। ক্যানভাসের ওপর দিকের সাদা অংশ এখনো ছায়ায় ঢাকা। কিছুটা কোবাল্ট ব্লু হালকা করে বুলিয়ে দিই ওদের ও্পরেও। এতক্ষনে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, নিজেদের গল্পগুলো ওরা এবার বলে দিতে চাইছে। আর ওদের আটকে রাখা যাচ্ছেনা। কিন্তু কি বলতে চাইছে ওরা? এখনো যে সব সাদা জায়গা পড়ে আছে ক্যানভাসে, এখন যারা বাইরে মেঘ করে আসায় আর একটু ছায়াছন্ন হয়ে এল, না, আমি এখনও সম্পূর্ণ ধরতে পারিনি ওদের কথা।
কিন্তু একটা কিছু আছে যা আমাকে প্রবলভাবে টানছে ওদের দিকে। একবার মনে হল ধারালো স্প্যাচুলাটা দিয়ে কয়েকটা নির্মম আঁচড় দিই ওদের গায়ে। আঘাতের পর আঘাতে যদি ওরা ওদের গল্প শুরু করে। সে সব কাহিনি আমার নিয়তি না পরিত্রাণ আমি জানিনা! কিন্তু এ ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই আমার।
কিন্তু তারপরেই মনে হল, এভাবে কি কথা বলানো যায় কাউকে? যায়না তো।
মানুষ কে না। ছবিকেও না। তবু ছবিটা নিজে থেকেই হয়ে উঠল একসময়। যদিও শেষ করার পরে বুঝিনি যে সে আরও কিছু বলতে চাইবে আমাকে। অন্য কোনদিন। অন্য কোনখানে।
গতকাল ও বাড়ি গিয়েছিলাম। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই গলি। তারপর বাড়ির মেইন দরজা। গলির একপাশে টানা লম্বা পাঁচিল । একসময়ে বাবা খুব শখ করে এই পাঁচিল বরাবর অনেক ফুলের গাছ লাগিয়েছিল। বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। সে সব গাছে এখন আর কেও জল দেয়না। পরিচর্যাও করেনা । গাছ বড় অভিমানী প্রাণ । যত্ন ছিলনা, তাই এই পাঁচ বছরে সেগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। মাটি শক্ত হয়ে গেছে অনেক। ফেটে ফেটে গেছে জায়গা জায়গায়। আশ্চর্য ব্যাপার তারি মধ্যে একটা বকুল গাছ কী ভাবে যেন জীবন খুঁজে পেয়ে গেল। টান টান দাঁড়িয়েও থাকলো সোজা। এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। প্রায় দোতলা সমান। মাঝেমাঝে তার ঝাঁকড়া পাতা ছেঁটে দিতে হয়। গতকাল গিয়ে দেখি, সেই শুকিয়ে যাওয়া টানা মাটির বাঁধানো জায়গাটায়, ওই বকুল গাছটার গোড়ায় একটা ছোট ছবির ক্যানভাস উল্টোমুখে পড়ে আছে। ছবিটা দেখা যাচ্ছেনা, শুধু তার কাঠের ফ্রেমের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। ছবির ক্যানভাসটা নিচের বাঁ দিক থেকে ডানদিকে ওপরের কোনা অবধি বেশ কিছুটা ফালা করা। সেই জায়গায় ক্যানভাসের কাপড় কেমন শিথিল হয়ে ঝুলে আছে। ছবিটা, কি মনে হল, সোজা করে দেখতে ইচ্ছে করলো। দেখি আমারই আঁকা একটা ছবি। সেই চালসা থেকে ফিরে যে ছবিটা অয়েলে এঁকেছিলাম, সেইটা। কালো নীল আকাশের মাঝে কয়েকটা বাড়ির ঢালু ছাদ আর তাদের টিনের চালের ওপর দিয়ে চাঁদের ছায়া গড়িয়ে নেমেছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূরের ধূসর নীল পাহাড়ের আভাস। সেই ছবিটাই। ছেঁড়াখোঁড়া ক্যানভাসের ফেলে দেওয়া, ধুলো মাখা বুকের ভেতর, পাহাড়ের ছায়া মেখে, এখনো যেন কোন বিস্ময়ের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনো তার রঙ বেশ উজ্বল; এখনো তার কোবাল্ট ব্লু আকাশের মাঝে ঝাপসা সাদা পাহাড়ের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়।
ছবিটাকে লোকে ফেলে দিয়ে গেছে। বাড়ির লোকেরাই। ছেঁড়া একটা ছবি। জঞ্জাল ছাড়া আর কী! জায়গা আটকে রাখা শুধু শুধু।

আর ততদিন, তার জীবনকালে, যে চাইছে, শুধু সেই দেখতে পাবে, এই ছবির, এই লেখার, এই কথাগুলোর অন্তর্লীন ম্যাজিক শো, যা শুধু পূর্ণতার কথাই বলে, বলতে চায়। বলতে চায়, শ্বাসরোধী সব অপূর্ণ মিলনের কথাও। এই তো তার কুহকী বিদ্যা। তার জাদু। তার মায়াপৃথিবীর আবহমান ম্যাজিক। জীবনের আর তার মৃত্যুরও।
বাকি সব কিছুই আসলে তো, জীবিত মানুষের অবহেলা আর ধুলোর অন্তহীন খেলা।
Comments
Post a Comment