প্রথম ব্লগ সংখ্যা
স ম্পা দ কী য়
আবহমান একটি ষান্মাসিক কাগজ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং দার্শনিক সন্দর্ভের। আমাদের মূল উদ্দেশ্যঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মিশেলে যে সময়খণ্ড আমাদের চালনা করে যাচ্ছে, তাকে অনুধাবন করা। কারণ সমকালীনতার আধার ছাড়া চিরকালীনতার আধেয়কে ধরা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আর ঠিক এ কারণেই শাশ্বত লুকিয়ে থাকে ক্ষণিকের মধ্যেই।
কারণ আমাদের জীবন ক্ষণিকের ঘেরাটোপে চিরকাল অনন্তসন্ধানী। চেতনাকে চৈতন্যসন্ধানী করে তোলার জন্য এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।
আর তার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল, বর্তমানে টুকরো টুকরো বোধিগুলোকে চয়ন করা। বর্তমান সময়খন্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তরুণ প্রজন্ম। সেই তরুণদের হাতে, ভাবনায়, কথনে এবং সৃষ্টিতে রচিত হয়ে চলেছে,- যে আবহমান সময়খন্ডের মধ্য দিয়ে তারা চলেছেন,- সেই 'সময়'।
সেই সময়কালকে অনুধাবন করতেই এই ব্লগজিন।
দুই বাংলার তরুণ এবং উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখকরা নিয়মিত লিখুন এখানে। কবিতা, ছোট ছোট গদ্য, বড় গদ্য- সব।
মনে রাখবেন, আমাদের কোনো পার্টি নেই, কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। নতুন ভাবনা আর নতুন দর্শন তথা ডিস্কোর্সকে আমরা স্বাগত জানাই।
একদিনে তো সময়টা পালটে যাবে না, একটু একটু করে পাল্টাবে। আসুন, সময়টাকে ধরে একটু ঝাকুনি দেওয়া যাক।
ব্লগের নির্বাচিত কবিতা বা গদ্য প্রকাশ করা হবে আবহমান মূল পত্রিকায়। এই ব্লগজিনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকবেন আমাদের আরো দুই বন্ধু মণিশংকর বিশ্বাস এবং বেবী সাউ।
হিন্দোল ভট্টাচার্য শ্যামল ভট্টাচার্য মণিশংকর বিশ্বাস বেবী সাউ
কারণ আমাদের জীবন ক্ষণিকের ঘেরাটোপে চিরকাল অনন্তসন্ধানী। চেতনাকে চৈতন্যসন্ধানী করে তোলার জন্য এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।
আর তার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল, বর্তমানে টুকরো টুকরো বোধিগুলোকে চয়ন করা। বর্তমান সময়খন্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তরুণ প্রজন্ম। সেই তরুণদের হাতে, ভাবনায়, কথনে এবং সৃষ্টিতে রচিত হয়ে চলেছে,- যে আবহমান সময়খন্ডের মধ্য দিয়ে তারা চলেছেন,- সেই 'সময়'।
সেই সময়কালকে অনুধাবন করতেই এই ব্লগজিন।
দুই বাংলার তরুণ এবং উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখকরা নিয়মিত লিখুন এখানে। কবিতা, ছোট ছোট গদ্য, বড় গদ্য- সব।
মনে রাখবেন, আমাদের কোনো পার্টি নেই, কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। নতুন ভাবনা আর নতুন দর্শন তথা ডিস্কোর্সকে আমরা স্বাগত জানাই।
একদিনে তো সময়টা পালটে যাবে না, একটু একটু করে পাল্টাবে। আসুন, সময়টাকে ধরে একটু ঝাকুনি দেওয়া যাক।
ব্লগের নির্বাচিত কবিতা বা গদ্য প্রকাশ করা হবে আবহমান মূল পত্রিকায়। এই ব্লগজিনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকবেন আমাদের আরো দুই বন্ধু মণিশংকর বিশ্বাস এবং বেবী সাউ।
হিন্দোল ভট্টাচার্য শ্যামল ভট্টাচার্য মণিশংকর বিশ্বাস বেবী সাউ
লিখেছেন গৌতম বসু মাসুদ খান সৌম্য দাশগুপ্ত গৌতম ঘোষদস্তিদার প্রবালকুমার বসু শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মণিশংকর বিশ্বাস দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় সুদীপ্ত মাজি গৌরাঙ্গ মোহান্ত কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় চন্দন ভট্টাচার্য ঋজুরেখ চক্রবর্তী কুন্তল মুখোপাধ্যায় গৌতম মণ্ডল চন্দন ঘোষ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপন চক্রবর্তী ওবায়েদ আকাশ বেবী সাউ দীপান্বিতা
সরকার প্রসূন মজুমদার পলাশ দে পৃথ্বী বসু অরিজিৎ চক্রবর্তী তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায় টিঙ্কু ঘোষ সুকৃতি অনিমিখ পাত্র তানিয়া চক্রবর্তী দী প্তিপ্রকাশ দে স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায় অর্ণব চৌধুরী শাশ্বতী সান্যাল চয়ন ভৌমিক অরুণাভ রাহা রায় গৌরব চক্রবর্তী সৌমাভ রিয়া চক্রবর্তী দেবরাজ চক্রবর্তী
অনুবাদ কবিতায় তদোগেন গিরতের কবিতা (সব্যসাচী সান্যাল), গিউসেপ্পে উনগারেত্তির কবিতা (হিন্দোল ভট্টাচার্য)
আলোচনায় বেবী সাউ (তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ)
গদ্য সুজন ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ
আলোচনায় বেবী সাউ (তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ)
গদ্য সুজন ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ
ধারাবাহিক গদ্য সর্বজিৎ সরকার
অনুবাদ কবিতা –
গৌ ত ম ব সু
চুক্তিবদ্ধ
বস্তুদিগের মধ্যকার কলহ
ব্যথিয়ুস
চুক্তিবদ্ধ বস্তুদিগের মধ্যকার কলহ,
সত্য বনাম সত্যের ইহা অনন্ত
সংঘাত,
সত্য একা সত্য; দুই প্রান্ত যদি
মিলাইতে
যাও,সত্য তৎক্ষণাৎ মিথ্যা হইয়া যায় -
দেবতাগণ কি জানেন বিভ্রাটের
কারণ ?
#
অথবা এমন যদি হয়, সত্য
ছিদ্রহীন,
প্রতি বস্তু অপর বস্তুর
মিলন-প্রত্যাশী।
কামনায় নিমজ্জিত, আমারই
ভ্রান্তির ফলে,
নিভন্ত অগ্নিকুণ্ডের ভস্মের
স্তূপ হইতে
উদ্ধার করিতে পারি নাই
যোগসূত্রগুলি ?
#
কী কারণে তবে সে আজি এত
বেদনাতুর,
রহস্য উন্মোচনের তরে এমন কাতর
?
যাহার লাগি এ-প্রদাহ, তাহারে
জানিল কী?
যাহা আছে,কেহ কি তাহারই সন্ধানে
ফিরিছে ?
সম্পূর্ণ অজানারে কেহ কি করে
অন্বেষণ?
#
অজানারে সে কেমনে করিবে অনুসরণ ?
লভিবে তাহা কোন্ পন্থায়,
লভিবার পর
কি উপায়ে চিনিবে উহারে ?
কহো,অন্তর্যামী,
তুমি কি একদা লভিয়াছিলে
বিশ্বচেতনা,
অংশত, না কি দেখিয়াছিলে পূর্ণ
কুম্ভ তা’র ?
#
ডুবিয়া মত্ত রহিলেও
ইন্দ্রিয়ের উল্লাসে,
আত্মা আপনারে সম্পূর্ণ বিস্মৃত
হয়ে নাই,
অংশটি ছাড়িয়া, ধরিয়া রহিয়াছে
পূর্ণতা ।
সেইহেতু কহি, যাহারা
মূলসত্যসন্ধানী,
চিত্ত তাহাদের শান্ত,
তৃপ্ত হইবে না কভু ।
#
কারণ, সে কভু লাভ করিবে না
পূর্ণজ্ঞান,
পূর্ণবিস্মৃতিও তাহার ভাগ্যে
লিখা নাই।
কেবল চূড়া রহিয়া যায়, সে
দেখিয়াছিল
যাহা, কেবল শিখর জেগে রয়
স্মৃতিপটে,
এবং, কামনা রহিয়া যায় বিস্মৃত
সত্যেরে
পুনরায় ফিরায়ে আনিতে আপনার মাঝে
।
ব্যথিয়ুস (৪৮০
?-৫২৪ ? খ্রিস্টাব্দ)
লেখকের নাম: অনিসিউস মানলিউস সেভেরিনুস ব্যথিয়ুস, সংক্ষেপে ব্যথিয়ুস
।
পঞ্চম শতাব্দীতে হূন, গথ ও ভ়্যাণ্ডল প্রভৃতি
তুলনামূলক ‘বর্বর’ জাতিদের লুঠতরাজে রোমক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছিল । গথদের ছিল দু’টি
প্রশাখা, ভ়িসিগথ (যাঁদের মধ্যে প্রধান ব্যাক্তিত্ব ছিলেন স্কুলপাঠ্য বইয়ের কুখ্যাত অ্যালারিক) এবং অষ্ট্রোগথ (এঁদের মধ্যে প্রধান
ব্যক্তি ছিলেন থিওডোরিক)। গথদের প্রথাগত
শিক্ষা না থাকলেও , তাঁরা নির্বোধ ছিলেন না, তাঁদের কেউ-কেউ দ্রুত বুঝে
ফেললেন, তাঁরা যে সভ্যতাকে ভেঙে চুরমার করছেন সেটির মনের স্তরের সঙ্গে নিজেদের
কোনও তুলনাই করা চলে না । তাঁরা নিজেদের
রোমানদের রাজনৈতিক প্রভু ও বৌদ্ধিক ভৃত্য মনে করতেন। প্রগতিবাদী গথদের
অন্যতম প্রধান থিওডোরিক এই কৌশল অবলম্বন ক’রে
এবং শিক্ষিত রোমানদের সহায়তা নিয়ে আধুনিক ইতালীর প্রায় পুরোটাই দখল ক’রে
নেন । ব্যথিয়ুস কর্মসূত্রে থিওডোরিক-এর
সাম্রাজ্যে অতিবিশ্বস্ত, অতিউচ্চপদাধিকারী প্রশাসক ছিলেন। পরবর্তীকালে ব্যথিয়ুস-বিষয়ে
থিওডোরিক-এর মনে নানা রকম সন্দেহ জন্মায় ।
রাজসভার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ব্যথিয়ুস-কে
কারাবাস, নির্বাসন এবং শেষ পর্যন্ত, শারীরিক নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড ভোগ
করতে হয় । ন্যায়, গণিত, সঙ্গীত, খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব, অ্যারিস্টটলীয় দর্শনশাস্ত্র
প্রভৃতি বহু বিষয়ে পুথি রচয়িতা হলেও, আজ তিনি আদিমধ্যযুগের একজন অন্যতম প্রধান
কবি-দার্শনিক রূপে সমাদৃত । অবর্ণনীয় নৃশংসতা ও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
কারাগারে রচিত তাঁর De Consolatione Philosophiae (The Consolation of Philosophy) একটি কালজয়ী গ্রন্থ । অনুবাদিত
কবিতাটি সেই মহাগ্রন্থেরই একটি টুকরো ।
ব্লক-এর প্রতি নিবেদিত কবিতা
৩.
তুমি এখন
চলেছ - সূর্যের পশ্চিম দিকে ।
সেখানে
তুমি দেখতে পাবে – প্রদোষের আভা ।
তুমি
চ’লে যাচ্ছ – সূর্যের পশ্চিম দিকে,আর
তুষারপাত ঢেকে দেবে তোমার পদচিহ্ন ।
#
আমার
জানালার সমুখ দিয়ে – উদাসীন
শব্দহীন
তুষারের ’পরে তুমি চ’লে যাচ্ছ
ভগবানের
দূত, হে পরমসুন্দর,তুমি
আমার
অন্তরের প্রশান্ত প্রভা হয়ে ওঠো ।
#
তবু আমি
নই তোমার শক্তির অভিলাষী
পথ
তোমার,## অবিনশ্বর #### ।
পবিত্র
চুম্বনে-চুম্বনে দু’হাত
পাণ্ডুবর্ণ
হল
তোমার, নখাগ্রে স্পর্শ করি নি তোমায় ।
#
নাম ধ’রে
আমি কখনও ডাকব না তোমায়
আমার দুই
বাহু মেলব না তোমার পানে
মোমসদৃশ
তোমার দিব্য মুখাবয়বের
সমুখে, দূর হতে
আমি রয়েছি নতজানু
#
অতিধীরে
নেমে-আসা তুষারকণার নীচে
বরফের
উপরে হাঁটু মুড়ে ব’সে পড়ব ।
কেবল
তোমার পবিত্র নাম নিয়ে চুম্বন
করব
রাস্তায় প’ড়ে-থাকা সন্ধ্যার বরফ;
#
রাজকীয়
পদচারণায়, যেখানে আমার
সমুখ
দিয়ে গোরস্থানের শব্দহীনতায়,
সগৌরবে,
তুমি আমায় পেরিয়ে চ’লে যাও,
দীপ্তিময়
তুমি, ও আমার আত্মার রক্ষক !
১৯১৬
মারিনা আইভানোভা ৎস্ভেতাইয়েভা (১৮৯২-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ )
রুশ সাহিত্যে দু’টি স্বর্ণ যুগের কথা শোনা যায়,
একটি কথাসাহিত্যে, অন্যটি কাব্যে; এর পরে, ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম বছরগুলিতে শুরু
হয়েছিল কবিতার রৌপ্য যুগ, যা বিশেষজ্ঞদের মতে, নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের
জন্মলগ্নের কয়েক বছর পর, অস্তমিত হয় । সর্বঅর্থে ব্যতিক্রমী কবি ৎস্ভেতাইয়েভা এসবের
মধ্যে একইসঙ্গে ছিলেন এবং ছিলেন না ।
অতিতরুণ বয়সে তিনি তাঁর চেয়ে এক বছরের কনিষ্ঠ জ়ারের সৈন্যবাহিনীর যে অফিসরের প্রেমে প’ড়ে তাঁকে বিবাহ করেন, সেই
সারজ়েই এফ্রন্ ছিলেন তাঁরই মতো কম্যুনিস্ট-বিরোধী, ‘শ্বেত রাশিয়া’র সমর্থক ।
রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য দেশের ভিতরে ও
বাইরে অবর্ণনীয় কষ্টভোগ, দাম্পত্য
কলহ, শ্বেত বাহিনীর পরাজয়ের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর স্বামীর ক্রমবর্ধমান
অনুগত্যপ্রদর্শন, স্বামীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ও শেষ পর্যন্ত ১৯৪১-এ
তাঁর মৃত্যুদণ্ড, দেশের বাইরে থাকাকালীন
‘মাদার রাশিয়া’র জন্য মন-খারাপ ক’রে
বেঁচে-থাকা আর দেশের ভিতরে নিত্য লাঞ্ছনা ; ৎস্ভেতাইয়েভা-র জীবন, বস্তুত, এক অন্তহীন
দুঃস্বপ্ন । ৩১ অগাস্ট ১৯৪১-এ তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। মৃত্যুর কুড়ি
বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর কবিতা আবার
বেঁচে উঠতে শুরু করে।
ব্লক : আলেক্সাণ্ডর আলেক্সাণ্ডরোভিচ্ ব্লক (১৮৮০-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ
), কবি । উচ্চতায় ও ব্যাপ্তিতে, পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
প্রভাব বিস্তারের নিরিখে, আলেক্সাণ্ডর
পুশ্কিন্-এর (১৭৯৯-১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ ) পরেই ব্লক-এর স্থান। অনুজ কবিরা ব্লক-কে
কি দৃষ্টটিতে দেখতেন তার একটি আভাস
বর্তমানে অনুবাদিত রচনাটি থেকে পাওয়া যেতে পারে । কবিতাটির কোথাও-কোথাও, বিশেষত
প্রথম দু’টি পঙক্তিতে, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চে গীত স্তবাংশের
ছায়া এসে পড়েছে । বর্তমান অনুবাদটি ১৯১৬-র রচনা হলেও, ‘Poems for Blok’ শীর্ষক
কবিতামালার পরের দিকের লেখাগুলি রচিত হয়
১৯২০-তে, এবং ব্লক-এর অকালমৃত্যুর
অব্যবহিত পরে, ১৯২১-এ। প্রসঙ্গত, ব্লক-এর সঙ্গে
ৎস্ভেতাইয়েভা-র বার দুয়েক সাক্ষাত হয়েছিল মাত্র, অগ্রজ–অনুজের মধ্যে যে
ঘনিষ্ঠতা আমরা অন্যত্র লক্ষ করি, তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ।
মা সু দ খা ন
প্রলাপবচন
নদ এসে উপগত হবে
ফের নদীর ওপর
দুই পারে জমে
উঠবে কপট কাদার ঘুটঘুটে কেলেংকারি
মাঝখানে
চোরাঘূর্ণি চোরাস্রোত
এলোমেলো এলোমেলো
বাউরি ভাবনা এসে
পাক খেয়ে ঢুকে
পড়বে বৃষ থেকে মিথুনের অধিক্ষেত্রে...
মাকাল ফলের মৃদু
মনস্তাপ
করলা-লতার
শ্যামলা আক্ষেপ
কোকিলস্য
প্রবঞ্চনা, কাকের বাসায়
উপঢৌকন
ভরা বিলের ওপর
দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর
হুদহুদ পাখির
অস্থিরতা, অসমাপিকার লঘু
তঞ্চকতা
একরোখা অশ্বের
অস্মিতা, উগ্রবসনা আগুনের
চঞ্চল রসনা...
আলগোছে সবকিছু
পাশ কেটে গিয়ে
ওইদিকে বর থাকবে
কনের বশে
খলনায়কের দাঁতের
নিচে পড়বে কট্টরপন্থী কাঁকর
চার্জ করা হবে
পশ্চিমের ব্লাস্ট ফার্নেসে
আর ঝাপটা এসে
লাগবে পূর্বেরটা থেকে
খামাখা দিওয়ানা
হবে রঙিলা বিড়ালিনী
ঘনঘন গণ-হাইপ
উঠবে মামুলি ঘটনা ঘিরে এমনি-এমনি
হিস্টিরিয়ায়
কাঁপতে থাকবে দেশকাল
সাত সাধু এক হবে,
এক শয়তান সাত
দোষযুক্ত আলু
নামবে হিমাগারের শ্রোণিচক্র থেকে...
এবং হয়তো আমি
একদিন ঠিকই
পড়ো-পড়ো ঘরকে
যোগাতে পারব
গাঁট-অলা
তিন-বাঁকা শালকাঠের সমর্থন
নিশ্চিহ্নকে
দেখাতে পারব কিছু লুপ্তপ্রায় চিহ্নের ইশারা
বিশেষকে কোনো
ভ্রান্তিকর নির্বিশেষের আভাস
বেদিশাকে দিশার
বিভ্রম...
আর দুম করে লিখে
ফেলব এমন এক কবিতা একদিন,
যা পড়ে ভৌতিক সুর
তুলবে একসঙ্গে সাধু ও শয়তান
সাপ-আর-অভিশাপে-গড়া,
মতানৈক্যে-ভরা
গামারিকাঠের গিটারে
আর ‘চলে আয়’ বলে খোদ খোদাতালা টুইট পাঠাবেন দিব্য টুইটারে।
সৌ ম্য দা শ গু প্ত
দেয়াল প্রস্তুত
দেয়াল প্রস্তুত, তুমি
স্বকীর্তিস্বাক্ষর রাখবে, প্রীতির আঙুলস্পর্শে মুখচ্ছবি, পিকনিকের ঘুম
প্রভূত পছন্দ পড়বে,
পছন্দ, পছন্দ, খুশি, খোলাজল এসে ঘরে বিছানায় জমাবে প্লাবন
তোমার আনন্দ তাই আমার
উপরে, বন্ধু, তোমাকে দেখিনি তবু পূর্বদিগন্তের আলোড়নে
তোমাকেই দেখি, শুনি,
ভাবি কত সমারোহে তোমার অবাধ চলাফেরার সন্ধান করে মন
জয়ধ্বজা হয়ে এসো, কলম ও
তিলক, ছৌ, বেইজ, লালন, আজ তোমাতে গুরুর সম্ভাবনা
এ-দেয়ালে অজন্তার
গুহাচিত্র রেখে যাও, একদিন তোমাকেই খুঁজে নেবে প্রত্নতত্ত্বজীবী
বিমুগ্ধদৃষ্টিতে দেখবে
বিগতযুগের তথ্য ছবিতে, সংঘে ও সত্যে, চিন্তামণি, রেখে যাও ধ্বনি
রেখো মা দাসেরে মনে, দেয়ালচলচ্ছবি,
সর্বসুখ রেখো ধরে, বিষণ্ণতা রেখো না এখনি!
গৌ ত ম ঘো ষ দ স্তি দা র
গণহত্যার ঘাটে
[ঋণ : ভাস্কর চক্রবর্তী]
কখনও যাইনি চিলেকোঠায়, কোনওদিন
হাসপাতালে বা চিতারচনায়ও
যতটুকু-যা, সবই ওই আলোবাতাসের টোলে,
কোলাহলের আখড়ায়—
আপনি সাদা-পোশাকে ঢুকতেন,
গোয়েন্দাপ্রধানের মতো, অন্বেষণপ্রবণ
দূর থেকে আপনাকে লক্ষ করেছি অভিভূত
খোচরের মতো, বিষাদবিকেলে
আপনি তো আসলে রঘুনাথকে খুঁজতেন বরানগর
থেকে কলেজ স্ট্রিটে এসে
পরে আপনাকে ভেবেছি সূযাস্তের আগে
নবাবি ব্যাটসম্যানের মতো
কিংবা, কখনও মনে করি কবিসাজহীন
সৌমিত্রনটের মতো, অনাটকীয়
সে-সব কল্পনা কেবল, আপনি তো আসলেই
শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকামাত্র—
আমাদের সকলের শালবীথি, সর্বোচ্চ,
গ্রিকপুরাণ-থেকে-উদ্ধৃত দেববিগ্রহ যেন
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কবিতালেখা
ছাড়া আর-কিছুই করেননি জীবনে
ভেবেছিলেন গীতিকবিতা নিয়ে একটা
হেস্তনেস্ত করবেন একেবারে নীরবে
পোস্টমাস্টারের মেয়ে গোলাপি যুবকের
সঙ্গে শুধুমাত্র জুতোজোড়া নিয়ে
বাড়ি থেকে স্বর্গের দিকে চলে গেলেও
আপনি স্বর্গের বদলে স্যারিডনে স্থির—
জিরাফের ভাষায় মেয়ের কথা লিখলেও,
স্ত্রীর বিষয় সবটাই অনুমানসাপেক্ষ
আমরা সেই প্রথম-কাব্য থেকেই আপনাকে
বুঝে পাইনি, বুঝিনি জলের সারল্য
অদ্রীশ আপনার রক্তমাংসের বিবরণ নিল,
আত্মহত্যার কথাও তুলেছিল সে
আপনি তো কবেই লিখে রেখেছেন, আত্মহত্যা
কিছুতেই নয়, অদ্রীশ পড়েনি—
আপনাকে সেদিন দিকভ্রষ্ট জাহাজের অবিচল
ক্যাপ্টেন মনে হল আমাদের
মানিক শামশের সুব্রত তুষারের সঙ্গে
যোগাযোগ ছিল, ছিল প্রত্যাখ্যানও
তবু, আপনিও গেলেন তাঁদের পাড়ায়, পরে
দেবাশিসও অনুগামী আপনার
খবর উড়ে আসে বৃষ্টিবাতাসে,
বাপ্পাদিত্য নিরাকার ছবি করছে আপনাদের নিয়ে
গণহত্যার ঘাটে গেলেই আপনাকে মনে পড়ে,
তুষার ও ফাল্গুনীর অবিনশ্বর পাড়া—
দেখি, রতনবাবু রোডে ভেঙে যাচ্ছে
প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবিদের সেই জমিদারবাড়ি,
চিতাদূরে বসে ভাবি, আপনি কি
উপমামাত্র, অদ্রীশ আজও আপনার সাক্ষাত্কারী!
প্র বা ল কু মা র ব সু
হয়ত অকাতরেই
কী দিয়েছি? দিয়েছি
কি কিছু তোমাকে
তাৎক্ষণিকের চিহ্ন বিহিত জলও
অকারণ শুধু দিয়েছি অবিশ্বাস
আর অন্ধকার, ঢেকে দিতে চেয়ে আলো
অক্ষম নাকি, এমন ভেবেছে যে নিন্দ্রকে
তুমি তো গ্রহণে কোথাও ্কৃপণ হওনি
আজ ফেরাবার কথা কেন তবে বলছ
হয়ত অকাতরেই দিয়েছি, যেমন ফুল ফুটে ওঠে মৌন
শু ভ্র ব ন্দ্যো পা
ধ্যা য়
পল মলডুন
আপনার কবিতা ১৯৬৮-১৯৯৮ নিয়ে বাইরে ক্যাম্পাসে সমুদ্রমুখি অ্যাবেরিস্টউইথ
বা আচমকা কোনও পড়ায় আমার ভয়ঙ্কর বাঙালি হ্রস্ব স্বরবর্ণহীন উচ্চারণে
বা আচমকা কোনও পড়ায় আমার ভয়ঙ্কর বাঙালি হ্রস্ব স্বরবর্ণহীন উচ্চারণে
যেভাবে দূরের কোনও জীবন পর্দায় পুরনো শব্দের মধ্যে দিয়ে উঠে যাচ্ছে
প্রাচীন রাজধানীগামী হাইওয়ে যেভাবে মেয়ে শিশুটির সোনালি চুল হাওয়ায় স্পর্শ করল বৃষ্টি
প্রাচীন রাজধানীগামী হাইওয়ে যেভাবে মেয়ে শিশুটির সোনালি চুল হাওয়ায় স্পর্শ করল বৃষ্টি
সেভাবেই আমি পালাতে চাইছি আচমকা
আবিষ্কার করা তরুণ
ঔপনিবেশিক অ্যাডমিরালের কবরের মত গিলতে আসা আমার জন্মের মফস্বল থেকে
ঔপনিবেশিক অ্যাডমিরালের কবরের মত গিলতে আসা আমার জন্মের মফস্বল থেকে
ম ণি শং ক র বি শ্বা স
শিশির
মনে হয় সাকোর
উপর এইতো সেদিন—সাঁঝের বেলায়—
একবার আলো
জ্বলে উঠে তারপর নিভে যায়
সূর্যাস্তের
রঙে নীল পতাকায় লেখা সেই নাম
জীবনের বাকি
সব ছবি কাগজের নৌকা বানালাম।
একটি পাখিও
যদি উড়ে যায় সেই শূন্যস্থান—
কোনো
শূন্যস্থান পূর্ণ করা এক অসম্ভব গান।
রাজকুমারী
তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে পথের দাবীতে
জীবন বদলে
গেছে, শুধু শুধুই জীবন গেছে বয়ে
যেন-বা
কাঙ্গাল এক পুরনো রাস্তার ধারে দাবিহীন শীতে
শীতকাল চলে
যায় দ্রুত, অন্ধকারে একা তাকে সয়ে
সান্ত্বনার মত
জানি, তবুও পথের মৃত্যু হয়, ক্রমে যেতে আকাশের দিকে—
অন্তিম জলের
আগে আমার এ অশ্রুজল, বিঁধে থাকে জানালার শিকে।
দী প ঙ্ক র
মু খো পা ধ্যা য়
কাদম্বরী: তিন
গোধূলি বিষণ্ণ
হলে মনখারাপ নৈঋর্ত মনে পড়ে তার। স্মৃতিবেদনায় ফিরে-ফিরে আসে মুগ্ধতার মেঘমালা।
ক্রমশ অবশ হয় স্নায়ু। সমস্ত ছলাকলা থেকে দূরে দক্ষিণের বারান্দায় ব্রাহ্মসঙ্গীত
গেয়ে ওঠেন ঠাকুর। আর রাতের ট্রেনের মতো দুর্বার ছুটে আসে যে মেয়ে, তার মুখে ঝলসে
ওঠে হাজার ফ্লাডলাইট। মুখ ঢাকার ফন্দিফিকির সে শিখে নিতে পারেনি। তার পরনে ঢাকাই
শাড়ি, কপালে লাল টিপ। পূর্ণিমার মোহাচ্ছন্ন উজানে সে ভেসেছে একা। অরক্ষিত অবগাহন
তাকে গর্ভ দিয়েছে। ওই যায়, নবনির্মিতির পথে ভেসে যায় স্বৈরিণী...তুমি তার পিছু
ডেকো না, কাদম্বরী!
সু
দী প্ত মা জি
পিতৃপক্ষে লেখা কবিতা
পিতৃপক্ষে লেখা কবিতা
কোথায় তোমার ঘর, আজ আর খুঁজেও
পাচ্ছো না...
পাচ্ছো না...
ব্যথার দু'হাত ভর্তি এতসব
সমাপিকা ক্রিয়া
গানের নোলক পরে ভরে ওঠা কান্নার উঠোন
এমন শারদপ্রাত এর আগে দু'চোখে দেখিনি
গানের নোলক পরে ভরে ওঠা কান্নার উঠোন
এমন শারদপ্রাত এর আগে দু'চোখে দেখিনি
অস্ফুটে বলেছো শুধু : দরজা
খুলে দাও,আর
সইতে পারছি না!
সইতে পারছি না!
দরজার দুই প্রান্তে ঘর আর
অচেনা বাহির
চিত্রিত জলের রঙে
অনিঃশেষ
আঁকা হয়ে উঠছে অবশেষে...
চিত্রিত জলের রঙে
অনিঃশেষ
আঁকা হয়ে উঠছে অবশেষে...
গৌ রা ঙ্গ মো হা ন্ত
দুটি কবিতা
তোমার কাছে যেতে
তোমার
কাছে যেতে উড়তে হয় অনেক দূর। ওড়ার জন্য কর্তৃপক্ষের আদেশ নিতে হয়, শরীর খুলে দেখাতে
হয় বিশুদ্ধ পরিকল্পনা। আকাশকে স্বাধীন মনে হয় না। আকাশ হয়ে ওঠে খণ্ডিত রাজতন্ত্র। আমি
খণ্ড খণ্ড আকাশের সীমানা পেরিয়ে যাই; বাতাসের শীতলতা আমার শ্বাসপ্রবাহে প্রভাব ফেলে।
আমি আকাশে হাঁটতে থাকি; যাত্রাপথ এক সেন্টিমিটারও কমে না। কখনো কখনো পরিভ্রমণের জন্য
পায়ের কোনো ভূমিকা থাকে না। বাধ্য হয়ে পা গুটিয়ে রাখি, আবার উড়তে থাকি। সময় জোন ভাঙতে
ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসি। তোমার কাছে আসতে আমার সবচে বেশি সময় লাগে।
হাওয়াপথ
বাতাস-এঞ্জিনের
শব্দের ভেতর নির্জনতা - পথছবি যে চুম্বনকে ঢেকে রাখে তা প্যাশন ফলের রক্তিম বর্ডার
পেরিয়ে আসছে। হাওয়াপথে নদীর ঢেউ বসানো থাকে। আমি ক্রমাগত দুলছি - নৈঃশব্দ্যের কাছে
ফুটে চলেছে পার্কফুল। আমার পাশে কয়েক ঘন্টার জন্যে কিছু যাত্রী কম্বলের নিচে মৃত্যুবরণ
করছে; তাদের নাকে জমছে শব্দফেনা। মানুষের বিচিত্র সুখের শার্ডোনে টেনে দেখাচ্ছে দ্রাক্ষাযৌবন।
আমি কেবল উন্মাদ হয়ে উঠছি - মাধব ঝরনায় ভিজে হেঁটে হেঁটে অপেরা গৃহে ঢুকছি - হার্বারের
কম্পিত গ্যাসপ্রদীপকে পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছি পার্কে। আমার কোনো সুখ নেই - আমি মৃতের
অভিনয় জানি
না।
ক ল্প র্ষি ব ন্দ্যো পা ধ্যা
য়
ফেরা
কেবল ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে
এই অসম্ভব কাঁপা শীতের বিকেল
তবু একটুও শব্দ হচ্ছে না কোথাও
একটুও লাগছে না কোনখানে
যেন একটা গাছ কাউকে কিছু না বলে
চুপচাপ নামিয়ে রাখছে পাতা
পাওনাদার শীতের ডিসেম্বরের
যেন একটা জন্ম ভিখিরি
অসহায় খুলে ফেলছে শাড়ি
দারোগা ডিসেম্বরের কাছে
অথচ বাতাসে দীর্ঘদিন কোন বিপ্লব নেই
অথচ আকাশ শান্তনীল পুরনো কবিতার মতো
শুধু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আশ্রয়ের লোভে বাড়ি ফেরা
শুধু অচেনা শহরে ঘটি হারিয়ে ফেলবার ভয়ে
সকাল সকাল বাড়ি ফেরা
একটু সন্ধে হয় হয় ...
প্রতিবেশীর বাসন আছড়ে পড়ছে আমাদের সদর দুয়ারে
বাবা রেগে গিয়ে মাকে কামড়ে দিচ্ছে
মা রেগে গিয়ে বাবাকে কামড়ে দিচ্ছে
দৃশ্যে দৃশ্যে গুলিয়ে উঠছে শহর
দেখি আমার বমি পাচ্ছে খুব
দেখি আমার পথ সরে যাচ্ছে ঘৃণায়
সকাল সকাল বাড়ি ফিরছি
একটু সন্ধে হয় হয়
কেবল ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে
এই অসম্ভব কাঁপা শীতের বিকেল
তবু একটুও শব্দ হচ্ছে না কোথাও
একটুও লাগছে না কোনখানে
যেন একটা গাছ কাউকে কিছু না বলে
চুপচাপ নামিয়ে রাখছে পাতা
পাওনাদার শীতের ডিসেম্বরের
যেন একটা জন্ম ভিখিরি
অসহায় খুলে ফেলছে শাড়ি
দারোগা ডিসেম্বরের কাছে
অথচ বাতাসে দীর্ঘদিন কোন বিপ্লব নেই
অথচ আকাশ শান্তনীল পুরনো কবিতার মতো
শুধু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আশ্রয়ের লোভে বাড়ি ফেরা
শুধু অচেনা শহরে ঘটি হারিয়ে ফেলবার ভয়ে
সকাল সকাল বাড়ি ফেরা
একটু সন্ধে হয় হয় ...
প্রতিবেশীর বাসন আছড়ে পড়ছে আমাদের সদর দুয়ারে
বাবা রেগে গিয়ে মাকে কামড়ে দিচ্ছে
মা রেগে গিয়ে বাবাকে কামড়ে দিচ্ছে
দৃশ্যে দৃশ্যে গুলিয়ে উঠছে শহর
দেখি আমার বমি পাচ্ছে খুব
দেখি আমার পথ সরে যাচ্ছে ঘৃণায়
সকাল সকাল বাড়ি ফিরছি
একটু সন্ধে হয় হয়
চ ন্দ
ন ভ ট্টা চা র্য
দ্বিতীয় রূপকথা
একজন দার্শনিক হিসেবে বলতে
পারি, তোমার আমাকে ছেড়ে যাওয়া ছিল আন্তর্জাতিক মানের ঘটনা।
তুমি পরিহার করেছ, আমার এই স্বীকারোক্তি অবশ্য আমার একধরণের চলে
যাওয়াকেও প্রমাণ করছে।
যতক্ষণ না কেউ বলে সে ফিরে
যাচ্ছে, নিয়মমতো ধরে নেওয়া হয়, মানুষটা
উপস্থিত; আর যদি মুখ ফুটে বলল ‘ঘর বাঁধলাম,
বাবি’, তবে তো কথাই নেই। কিন্তু একজন দার্শনিক
সংক্ষেপে একজন দার্শনিক বলেই এই কাছে থাকা বা দূরে যাওয়ার রহস্যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস
রাখে না। সে জানে, যেমন কাল্পনিক বিদায় আছে, তেমনি কাল্পনিক উপনিবেশও, তাই শুরুতেই দ্বিতীয় রূপকথাকে
ভেঙে দিতে এগিয়ে আসে।
আবার, হারিয়ে যাওয়াকে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, বা প্রস্থানের অভিনয়ের
সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না, যদিও বলা যায়, অভিনয় সবচেয়ে স্থায়ি বাস্তবতা।
তুমি বলেছিলে পাশে আছি, তারপর দেখা গেল মুছে দিয়েছ আমাকে; তাহলে আইন মতো ধরলে,
পাশে থাকার সময়ই অগ্রহণ করেছিলে। শুধু তাই নয়, তুমি অনন্তকাল ধরেই দূরে আছ। মানে, ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে
একরকম অসীমতা রয়ে গেল। যদি শান্ত আর শান্তিতে থাক, মনে হতে পারে
বুঝি আমার মন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছ। আবার এমনও
ভাবা যায় যে তুমি হয়তো সম্ভবত শান্ত শান্তিতে বিরাজ করছ অন্য কোথাও।
তাহলে, পরিবেশ সব সময়ই সংকটে রয়েছে। অথচ, আমরা দুঃখের লাগোয়াভাবে
সংকটের কথা বলি, সুখের সংযুক্তে বলি না। কেন বলি না?
যদি শক্তি হিসেবে দেখা যায় --- তোমার চলে যাওয়া ভীষণ সৌন্দর্যময়, যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে
করে। কারণ সৌন্দর্যের গভীরতম ভেতরে বিচ্ছেদ রয়েছে আর সে খুব ক’রে ওখানটাতেই থাকতে চায়।
ওকে বসতে দিও।
ঋ জু রে খ চ ক্র ব র্তী
নাম
আসলে প্রশ্রয় থাকে প্রেমের শরীরে।
পোশাকি নামের সুতো ছিঁড়ে
নতুন নতুন যত ডাকনাম উঁকি দিয়ে যায়
কখনও মায়ায়,
কখনও ছুটির অবকাশে,
কখনও বা হাত ধরে টেনে নিয়ে রাস্তা পেরুতে গিয়ে সচকিত,
বিচ্ছেদ আসন্ন জেনে শোক-অবহিত
সেইসব মুহূর্তেরা নিভৃতে কোমলতর ত্রাসে
তোমাকেও সঙ্গোপনে তেমনই জড়ায়।
কোনও কি নিথর অভিধায়
তোমাকে আঁটাতে পারি, বলো, এই আশ্রয়ের অনৃত তিমিরে?
বাহ্যত প্রশ্রয় থাকে, ছদ্মনাম মিশে থাকে ভিড়ে।
কু ন্ত ল মু খো পা ধ্যা য়
একটি প্রতিবেদন
আমার ডায়ালিসিস-দিদিভাই দুর্বল এবং
হাঁটতে গেলে টাল খেয়ে পরে যান । কিন্তু ,সুস্থ অবস্থায় ,দিবসের পর দিবস কাজ করে করে তাঁর
মনের শক্তি এতটাই যে , রিকসায় চাপার সময় যদি সাহায্য করতে যাই ,তিনি ধমক দেন আমাকে
। ফলত আমি একা একাই উঠে পড়ি বাহনে এবং দেখতে থাকি মজা । আমি এর শেষদৃশ্য জানি এবং
অপেক্ষা করি অন্তিম মুহূর্তের ।দিদিভাই রিকসার কাঠামোর লোহার দণ্ডটিতে পা দিয়ে
উঠতে যান ।পারেন না ।আবার চেষ্টা করেন ।পারেন না ।এরপর লোলচর্ম কাঁপাকাঁপা হাতদুটি
উপরের দিকে বাড়িয়ে ধরেন ...মুহূর্তে ওই বাড়ানো হাতদুটি মনে হয় আজানের মুদ্রা
...মুহূর্তে মনেহয় যেন সমস্ত মানবতার হয়ে এই বিশ্বপ্রকৃতির কাছে ভিক্ষা চাইছে
মানুষ ...
রিকসার উপর থেকে আমি , ঈশ্বর ,
প্রতিদিন এই মজার দৃশ্য দেখি ।
মন ও মাধবীজুড়ে বৃষ্টি পড়ে
গৌ ত ম ম ণ্ড ল
বৃষ্টি
যে নদী রাত্রির কাজল, তার তীরে
এসে দাঁড়াই,বসি
দেখি নীলে ছেয়ে গেছে আকাশ
একটি দুটি পাখি উড়ছে
আর শব্দ করে
টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিশির
যতবার এই নদীতীরে আসি
ততবার বনপথে ডেকে ওঠে কোকিল
চ ন্দ ন ঘো ষ
মাতাল
রাত্তিরে মাতাল কথা বলে
কথা, কথা, কথা
শব্দের বুদ্বুদ ওড়ে, শব্দের
বুদ্বুদ ফেটে যায়
বধির ফোনেরা খুব নিশ্চিন্ত
মুখে
হাঁ হাঁ করে, হুঁ হুঁ করে
যেন সব দু অক্ষর চার অক্ষর
সেঁধিয়ে যাচ্ছে পেটে চুল্লুর
মতন
মদের দোকানও হেসে ওঠে
হা মাতাল, হো মাতাল বলে
বুক চাপড়াতে থাকে শুধু
আত্মাকে হরি শা মার্কেটে
বেচে দিয়ে
মাতাল উলঙ্গ হয়ে যায়
তারপর হু হু করে কেঁদে ওঠে
রাস্তায় রাস্তায়
বধির ফোনেরা হাসে
শুনতে পাচ্ছে যেন কী না
জানি গভীর সংবাদ।
বি না য় ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
স্বতঃসিদ্ধ
বলার কিছু নেই;
এগিয়ে যাও, দেখতে পাবে
পর্দা সরালেই।
সরাতে পারছ না?
কী করে আর পারবে বলো,
পর্দাটা তো সত্যি নয়, আঁকা;
দেখলে যাতে সত্যি মনে হয়
সত্যি করে সত্যি মনে হয়
তোমাকে তাই মাইনে দিয়ে রাখা...
স ন্দী প ন চ ক্র ব র্তী
লোকে ভাবে
শ্রাবণ শরীরে এসে গোঁয়ার মোষের মতো
দাঁড়িয়ে রয়েছে
রক্তের রেখার মতো ধুয়ে গেছে লালমাটি,
শালের জঙ্গল
শব্দের স্ফটিক ভেঙে হরিদ্রা বর্ণের
আলো খুঁজেছে রাক্ষস
প্রতিদিন বাড়ি ফিরে এসেছে সে
আমাদের কণ্ঠনালী ভেদ করে রক্ত খাবে
বলে
এই সাদা পাতা এই থার্মোমিটার
আমাদের জ্বর খেয়ে রক্ত খেয়ে ফুলে ওঠে
লোকে ভাবে, কবিতা লিখেছে
ও বা য়ে দ আ কা শ
গগন ঠাকুর : গণিতজ্ঞ
গগন ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন
লিটল ম্যাগাজিনের দুর্মূল্য খাঁচায় তার নাম
যাদুঘরের প্রহরী-বেষ্টিত উজ্জ্বল হয়ে আছে
জীবনে প্রথম তিনি ভাষাবিজ্ঞান থেকে নেমে
লোকসংস্কৃতির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন রিক্সার চাকা
তারপর নাটক সরণির মুখোশের কেনাবেঁচায়
গণিত বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন
এবং যে কোনো বাহাস কিংবা প্রথম প্রথম কবিতার খাতায়
ব্যাকরণ থেকে জ-ফলা কিংবা নৈতিকতা থেকে ঐ-ফলা ছিঁড়ে
বাতাসে উড়িয়ে দিতেন বলে
একদা এ্যান্টি এশটাবলিশমেন্টের কয়েকজন তরুণ কর্মী
তাকে গভীর উৎসাহে গ্রেফতার করে
নিয়ে যায়
বলে, যে কোনো স্কুলিংয়ের নির্জনতায় জনসভার উত্তেজনা
কিংবা কফি হাউসের ছায়াতলে সরাইখানার পরাপাঠ
রটিয়ে দিতে পারলেই তবে মুক্তি
কোনোদিন মুক্তি নেননি গগন ঠাকুর
বরং দীর্ঘ কারাবাস কালে তিনি এ্যালজ্যাবরার প্লাসগুলো একদিকে
এবং বন্দিজীবনের নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তিগুলো একদিকে রেখে
প্রতিদিন ঘুমোতে অভ্যস্ত ছিলেন
একদিন যোগের সঙ্গে ভাগ এবং নিঃসঙ্গতা ও অপ্রাপ্তির সঙ্গে
গুণীতকের গভীর সখ্যের দরুন ওরা মধ্যরাতে হাত ধরে পালিয়ে চলে
গেল
অথচ তিনি প্লাসের সঙ্গে মরালিটি এবং
মাইনাস ও একাকিত্বের সঙ্গে হিউম্যানিটির সমন্বয়গুলো
গভীর কাছ থেকে ভেবে এসেছিলেন--
গগন ঠাকুর গণিতজ্ঞ ছিলেন। এ-মতো গাণিতিক সমস্যা
জীবনে এটাই প্রথম বলে তার মীমাংসা হেতু
নতুন কোনো লিটল ম্যাগাজিনের খাঁচার দিকে তাকিয়ে আছেন
বে বী সা উ
গান লেখে লালনদুহিতা
সমস্ত ভাসাও জেনে পেতে দিই ভোরের
আজান
আমিও পথিক যেন অনন্তের জমে থাকা
গান
এই মৃত্যু এই আলো ক্ষণে ক্ষণে ভেসে
ওঠা শোক
দিনরাত কারুকাজে লিখে ফেলে পদাবলী
শ্লোক
ভেঙেছ রাতের গান চারিদিকে নিশিডাক
কাঁদে
কেন যেন কার ঘরে পেতে ধরা প্রতিমার
ক্ষিদে
একে একে বের করে পুঁথিপত্র। ইস্তাহার।
শেষ
জমানো আলোর নীচে ছাইভস্ম মাখে দরবেশ
যে গান রাতের শুধু মন্ত্র পাঠে বাজে
শীৎকার
বিসর্জন ভেবে দেখি গানচোখে জমা শোক
তার
আসলে বিচ্ছেদ দৃশ্য পথে পথে রাজার
মতন
লিখে ফেলে মহাকাব্য শোকগান আর জন্ম
ক্ষণ
সুজন তাকেই বলি হাতে হাত বাষ্প পেতে
ধরে
তুমিও সহজ জেনে পাটাতন লিখেছ নিবিড়ে
দী পা
ন্বি তা স র কা র
পাথরের
দিনরাত
নক্ষত্রের পথ দুলে দুলে ওঠে তার কন্ঠ বরাবর
প্রতি শ্বাসে অতিকায় মূর্তি দেখি, প্রতিমার খড়
মাইল মাইল সাঁকো আর হাওয়ার কিছুমাত্র ক্ষত
ডুবুরির চোখ থেকে খসে পড়া রাত কি সম্মত?
পাথরের দিন রাত স্তব্ধতার মত কেঁপে উঠি
পাথরের দিন রাত স্তব্ধতার মত কেঁপে উঠি
সে যত বধিরপ্রিয়, ধুলো ভরা মুঠি
বায়সবিকেল জুড়ে গানখানি সত্যি হোক তবে
আহা দূর মায়া চোখ আঁকা ছিল গর্ভঅসম্ভবে!
আহা দূর মায়া চোখ আঁকা ছিল গর্ভঅসম্ভবে!
দেহস্রোতে নতমুখ ডুবে যাই সেই রাত্রি শেষে
কণ্ঠ যদি ওঠে দুলে জন্মজরা বিষণ্ণ আশ্লেষে
প্র সূ ন ম জু ম দা র
একা
অশ্রুবিন্দু প্রধানত পাখি।
নিবিড় একাকী।
স্তব্ধতারা নিঃস্বতা কাঙাল।
আঘাত? না না- আঘাত? ফাঁকি।
কথার চালাকি।
দূর থেকে দূর থেকে আরো দূর যাওয়া।
যাওয়া।
নিবিড় একাকী।
গাছ থেকে গাছ থেকে অন্যতর গাছে
উড়ে যায় পক্ষহীন পাখি।
আবার একাকী।
প লা শ দে
প্রেগন্যান্সি
কেউ অস্হির নিয়ে কথা বললে
আমি তোমার দিকে আরো হরিদ্রাভ হয়ে যাই
ঘূর্ণন ঘূর্ণন আন্দোলন গুঞ্জরিয়া ওঠে
পুরুষে বরশি বাঁধা
ভৈরবী চক্রাকার
মধুচক্র নিয়ে কেমন সাইরেন বাজে
দ্যাখো চারদিকে
তুমি তো মশারি টাঙিয়েই শুতে যাও
দেখি, মাঠে ছাদে শূন্যতায়
পুলিশ আসে কবি আর যত ভ্রমরীয়া
ঘূর্ণন ঘূর্ণন আন্দোলন বাঁশি বাজাচ্ছে
মাটি উপুড় করে আজকাল প্রেগন্যান্সি
টেস্ট করা হয়, তুমি, জানো?
পৃ থ্বী ব সু
ডিপ্রেশন
১
একাকীত্বের দিন তুমি ধোঁয়া,
কীভাবে যে উঠে আসো! চারিদিক ঝাপসা
হয়ে যায়...
মাথা ঝিমঝিম করে, পা টলে- আর
হলুদ বিবর্ণ সব ফিল্টারের মত
দিনক্ষণ
পড়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
২তোমার জীবন থেকে যে কারণে সরে যেতে হল
যেখানেই ছায়া দেখি, অধিকারবোধ জেগে ওঠে।
ইদানীং স্নানঘর, সারাদিন একটানা শিস,
জলের তফাতে আমি কবেকার পুরোনো কাঠামো
জলের গভীরে যেন জমা পলিমাটি আমি, একা
ব্রেলঅক্ষর
যে, কোনো সূর্যাস্তে আমি প্রার্থনারত অন্ধঠাকুমার কাছে চলে যাই ;
সম্পূর্ণ শোকের মতো এই জীবন তোমারই পথের ফুল চেয়ে
নিবিড় পথিক…অস্থিরতার গোপনে ভাসিয়ে দিয়েছে নিজেকেই…
আর সর্পগন্ধার-মূলে উচ্চরক্তচাপ কমানোর কৌশল কোনো
ত্যাগের আশ্রমে আমাকে নিয়ে যায়…ভাবি, যযাতি
আমার তীর্থ বাকিসব ভুলে যাওয়া ইমনের কল্যাণ…
কোনো এক গঞ্জের রাতে আমার দাদুর মতো মুগ্ধ তথাগত
শরীরের মূত্রে পাওয়া ইউরিয়াধারা ক্ষেতের জমিতে ঢেলে দেয়
কোনো কোনো শোকে আর সন্ন্যাসে ভিটামিন এ- এর অভাবে
কৃষকেরা রাতকানা হয়
আকাশের তারারন্ধ্রগুলি চোখে প্রবেশ্য আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে…
আমি সব অসহ্য অতিক্রম করে ছুটে যাই অন্ধ ঠাকুমার
কাছে জুঁইভরা অশ্রুর মতন !
ঘোড়ার আদিমপুরুষ ইওহিপ্পাসের সাথে ভাগ করে নিই সামান্য উঠোন…
বাড়ি ফিরি মাঝরাতে । এলোমেলো যেখানেই যাই
একটা অদৃশ্য হাত আমার পিঠ ছুঁয়ে থাকে…
উজানমণির খোলা তটে চিরবিস্ময় দাদু
স্বভাব বালকের মতো প্রতিবর্তক্রিয়ায় সাড়া দেয় আজও
আমার অগ্রন্থিত ব্রেলঅক্ষরে লেখা কবিতা উদাসী কবিতায়
নির্দেশক
ভুলে গিয়েছেন কিংবা অনুভবে রেখেছেন তুলে।
নিয়ন আলোর দিন।
অবসন্ন ভীরুতা আর ক্যামোফ্লাজিক গন্ধে অসহায় হয়েছে সেই মুখ,
যার নামে মৃত্যু রচিত হয় পরপর।
হে মহানুভব,
আপনি তাকে চেনেন?
টি ঙ্কু ঘোষ
আব্বাসুদ্দিন শোনা ভাই
কবিতা এমন জিনিস, লিখে যেতে হয়। থামলে চলে না। অনেকটা
ঘড়ির মত ঠিক হোক ভুল হোক টিকটিক শোনাও সময়। আমরা তো চিরকাল এই নিয়ে উৎসাহ হুল্লোড়
কাটিয়ে দিলাম প্রভূ তোমার জন্মদিনে নেত্য করিনি বলো প্রার্থনা করিনি বলো বাবারও মৃত্যুশয্যায়!
এইবার থামুন তো। থাম লাঞ্ছনা আছে? আমার পেনের মুখ আমি জানি কালি মাখা এবং সত্যেরও কাছে।
অন্ধকারের কবিতা
ফাঁকা হলেওতো ঢোল বাজে
তবে মাথা বাজলে দোষটা কিসে ভাই!
তুমি তো শব্দই শুনতে চাও
ভোর থেকে আরতি অবধি,সন্ধ্যা শেষ,,,
শেয়াল হাওয়াও,,,
অন্ধকার বাড়ির মতন আগোছালো
রঙিন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছি আর
চোখের সামনে অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়েছি যেই
দেখি তুমি, চিত হয়ে শুয়ে আছো অন্ধকার
বাজাও আমাকে, আমি কতখানি ভূত
বাজাও আমাকে, আমি কতটা রাক্ষস
আমাকে বাজিয়ে দ্যাখো, আমি পুরোষই বা কতখানি
অন্ধকারে খেজুর গাছের মতো
ঠিলের ভিতরে ঢালি রস।
ফাঁকা হলেওতো ঢোল বাজে
তবে মাথা বাজলে দোষটা কিসে ভাই!
তুমি তো শব্দই শুনতে চাও
ভোর থেকে আরতি অবধি,সন্ধ্যা শেষ,,,
শেয়াল হাওয়াও,,,
অন্ধকার বাড়ির মতন আগোছালো
রঙিন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছি আর
চোখের সামনে অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়েছি যেই
দেখি তুমি, চিত হয়ে শুয়ে আছো অন্ধকার
বাজাও আমাকে, আমি কতখানি ভূত
বাজাও আমাকে, আমি কতটা রাক্ষস
আমাকে বাজিয়ে দ্যাখো, আমি পুরোষই বা কতখানি
অন্ধকারে খেজুর গাছের মতো
ঠিলের ভিতরে ঢালি রস।
অ নি মি খ পাত্র
একটা লেখা
একটা লেখাকে আর কতদূর সহ্য করা যায়?
তার চে বরং ভাল দুমদাম শরীরস্থাপন
যতেক গভীরবাসা বর্ণনায় নষ্ট হয়ে যায়
ব্যথা নীল, রাগ লাল, সোনালি আশার
কী রঙ সহ্যের? সে প্যাস্টেল নাকি আক্রিলিক?
তার ক্যানভাস বড়ো। তার শৈলীর নাম মুহুর্মুহু
সে বড়ো অসহ্য। তার চাপ
খুবলে নেয় আত্মজীবনীকে
কতদূর সহ্য করা যায় ভাই একটি লেখাকে?
তা নি য়া চ ক্র ব র্তী
প্রলাপ
এইসব এখনো হয়
এখনো বহুদিন পেয়ারা
গাছের দিকে তাকিয়ে
শরীরে জ্বর আসার কথা
ভাবি,
তাপের যে উত্তম শোষক
সেই তাপের উত্তম
প্রতিফলক!
শুধু জায়গা বদলের
খেলা
মানুষের সাহস দেখে
ইতি-উতি হাসি পায়
গোটা জীবনের জ্বর
দেহস্থ হলে
পৃথিবীকে ভালবাসার
উনুন ভাবতাম
একানরে ও তার গল্প
এখন খুব পূর্ণ লাগে
এসব রোদছোঁয়া অবশ
দুপুর
জীবনকে বালিতে ফেলে
বাদামের খোসা ওড়ানোর
মতো
নশ্বর দেহকে এত কাহিক
করেছি কেন?
ভাবলে কবিতা নয় সুস্থ
প্রলাপ আসে খুব---
দী প্তি প্র কা শ দে
ক্ষত
একদিন
ঘুম
থেকে উঠে খুব ভোরে
আঙুলের
ছাপ খুঁজতে বেরুব আমরা
খালি
পায়ে
যে-যার
নিজের শহরে
তারপর
সেইসব ছাপ বুকে নিয়ে
বুনো
রোদে শুকনো করে, আগুনে পুড়িয়ে
লিখে
ফেলব সময়, যা আসলে বিগত...
রক্তে
যাদের আজও অভিকর্ষ-টান
আর
গোড়ালিতে
থেকে গ্যাছে পেরেকের ক্ষত!
স্রো ত স্বি নী চ ট্টো পা ধ্যা য়
প্রেমিক
না পাওয়ার জঠর থেকে
তৈরি হচ্ছে একটি তমস্যার আখ্যান
এখন ধীর গতিতে পাশ কাটিয়ে
চলে যায়
দু একজন যুবক
এই প্রগাঢ় অন্ধকারে সেই একটি
দুটি মুখ
পরিচিত মনে হয়
মনে হয়, কবে থেকে যেন
কিসের এক ঘোর
আমায় দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলছে
আমি সঠিক নির্ধারণ করতে পারছি
না বলে
ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি ব্যপক
আকুলতায়
আর তুমি শিকারি কুকুরের মতো
আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছ
আমার ঘ্রাণে গা শুকিয়ে নিচ্ছ
প্রতিনিয়ত
অথচ সন্ধ্যা নামলেই
যে অপলক দুটি চোখ তাড়া করে
নিয়তির শীর্ষবিন্দুতে বসিয়ে
দেয় তোমায়
তুমি তাকে আজীবন ভয় পেয়েছ
মন্ত্র আওড়েছ
এই শাশ্বত পৃথিবীতে
একমাত্র তোমার যেন কোনও ক্ষতি
না হয়
অ র্ণ ব চৌ ধু রী
গোলাপ গর্ভের পাখি
আমি সে জন্মের কারিগর, গর্ভ থেকে ফুল
খুঁটে খুঁটে উড়িয়ে দিয়েছি পাখি – বহুদিন পর দেখি পড়ে আছে
ফুলের উপমা- আমি সে প্রেমিক ভিক্ষু হাতে ধরি গোলাপের থালা , ছোট উপহার, চুলের বাহার আরও সব মুখরা নিয়ম –ছুটে যাই পদ্ম সরোবরে –তুলে আনি রতিপ্রিয়
নারী- বাতাসে মাটির গন্ধ । এসো হে সুন্দর , বাতাসের গায়ে
লিখি চক্ষুশূল ময়ূরের নাচ- অলীক কাহিনী ছুঁয়ে মেঘমালা চলে যায় নৈশ অভিযানে- আজ তারা
তারা আলো জ্বালিয়েছে কেউ- আলোর দুপাশে লাট খায় নেশা ধরা অর্ধভুক্ত চোখ, আমি সে চোখের পালক তুলেছি আর উড়িয়ে দিয়েছি নীচু মুখে- মায়াবী দীঘির
মাঝে- ভোরের শিশিরে- লন্ঠন নাচানো ছাদে, এসো হে সুন্দর,
জন্ম ছেনে মেখে নিই উপচে পড়া নরকের জল- সমস্ত অভিসন্ধির মতো পড়ে থাক তোমার প্রকাশ
শা শ্ব তী সা ন্যা ল
নৌকো
নৌকোটি এখনো ভাসছে
মোহনা ছাড়িয়ে স্থির জলে
অভিমানী নোঙরের
নীচে কাঁপে বিষাদের মেঘ
নৌকোটি এখন আর
তেমন যুবক নেই ব'লে
শিকড়ে বয়স বাড়ে।
ভেঙে দেয় জলজ আবেগ
মাঝির শরীরে রোদ,
সেই তার লজ্জানিবারক
এসো রোদ, পা ঝুলিয়ে
বসো এই ভাঙা পাটাতনে
কবে কোন কুমারীর
নরম হয়েছে আলতাদাগ
রঙ ধুয়ে গেছে,
স্রোত রাখেনি সেসব কথা মনে।
স্রোত, তুমি কোথা
হতে আসিতেছ? কোন দিকে যাবে?
সে কোন মুনির
জটা, শিশুকাল- মনে কি পড়েনা?
কে তোকে ভাসিয়ে
দিলো? মানতের মেয়ে... এ বয়সে
নরম প্রবাহ নেই,
আশরীর ফেনা আর ফেনা
নৌকোর পাঁজরে
তবু লেগে আছে কুমারীত্ব, ঢেউ
জলজ সে উপকথা
মাঝি জানে, জানে কেউ কেউ...
চ য় ন ভৌ মি ক
ছাইগাদা
বাবা যখন জল পাম্প করছিলো
বাইরের টেপা কল থেকে ।
সি আর পি এফের গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঠিক তখনই
থাম ফুটো করে থেমেছে ভিতরে
ক্ষতচিহ্ন
রেখে।
সত্তরের সেই শীতের রাতে জন্মাইনি আমি,
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই যেন
ভারী বুটের শব্দ পাই, কেঁপে উঠি
সেইসব বর্ণিত সন্ত্রাস এখন আমারও চোখে।।
অ রু ণা ভ রা হা রা য়
দেরি
তোমাকে স্কুলের ড্রেসে কখনও
দেখিনি৷
তোমার কলেজ-বেলা: সেটাও
অজানা
এত পরে কেন এলে আমার গভীরে?
অফিস ছাড়ার দিন কথাও বলিনি!
ঈষৎ তাকানো-মুখ মনে পড়ে
তবু...
আজ এই অনুতাপে গলে যায় পাহাড়ি
বরফ
আরও আগে দেখা হলে
হতেও তো পারত বলো, প্রেম
আমাদের...
অথচ নামের কোনও দায় নেই--- শব্দটুকু ছাড়া…
রি য়া চ ক্র ব র্তী
আগুন নদী
সময়ের আলিঙ্গনে
মুহুর্মুহু শিহরিত।
আমিই ভরা বর্ষায়
অভিমানে ছলকে ওঠা নদী ।
হাতের মুঠোয় নেচে ওঠে
আমার রুক্ষ্ম সময়
আলো নই, অন্ধকারও নই
আমি সেই আগুন নদী
ছুঁয়ে এসেছি
সুদুর দক্ষিণ
অনুবাদ
তদোগেন গিরতের কবিতা
অনুবাদ স ব্য সা চী সা ন্যা ল
তদোগেন গিরতে পেশায় শিক্ষক। মঙ্গোলিয়ার ওন্দোরহান বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়ান। কবিখ্যাতি সেভাবে নেই। কোনো প্রকাশিত বই নেই। সময় কাটানোর জন্যই লেখালিখি করেন। তাঁর নিজের কথায়; “কবিতা নিয়ে সেরকম কোন অ্যাম্বিশন নেই। তা’ছাড়া আমার লেখাগুলি যে আদৌ কবিতা—মঙ্গোলিয়ার কোন দৈনিক বা পত্রিকা সে কথা স্বীকার করে না।“
*তদোগেন গিরতের কবিতা - ১
আমি নোংরা মেয়েদের কাছে যাব
কাঠের নথ নিয়ে যাব
আমার বাহুর মাংসে গিঁথে গোবি ভাল্লুকের দাঁত
আমার কোন নিষেধ নেই
আমি নোংরা মেয়েদের মুখের ভেতর
ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, আর কাঁপছি
কোঁচকানো মুখের চামড়া টান করে দিচ্ছি
আমার কোন নিষেধ নেই
ঘাসের মধ্যে উঠে দাঁড়াচ্ছে সারস
ওর চোখের পাতা লাল
ওর পিঠের রঙ কালো
চকচকে দুই দাবনার মাঝে সবচে মিষ্টি ওর পুটকি
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ২
আমার নাম তদোগেন গিরতে
তদোগেন গিরতে বলে কেউ নেই
আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌয়ের বোঁটা খুঁড়ে দিয়ে যায় কাক
আমি স্তেপ পেরিয়ে আর নদী পেরিয়ে
নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
আর দেখি ওর বিছানায় রাত্রি
আর দেখি ওর বিছানায় দু’পায় রাত্রিকে জড়িয়ে
বনশুয়োর
আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌ বলে কিছু নেই
আমি নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
পুরো মঙ্গোলিয়ায় কোন নোংরা মেয়েছেলে নেই।
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৩
সে সারাদিন তাইমেন মাছ কাটে
উবু হয়ে বসে ট্রাউট কাটে
ওর তলপেটে মাছের গন্ধ
আমরা দিনের বেলায় করি,
করার পর আমার তলপেট মাছ হয়ে যায়
রাতে যখন চিকচিক করে জল
আমার তলপেট বরফজলে সাঁতরে বেড়ায়
সে ভোরভোর তাকে খ্যাপলা জালে ধরে
আর কেটেকুটে বরফের ওপর রেখে দেয়
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৪
আমি পাল্লা বেড়ালের ধুমসো লোম
থেকে শব্দ বাছি
আমি আর্গালি ভেড়ার পেট কাটতে কাটতে
শব্দ তুলে আনি
আমি তথাগতর সামনে ধুপকাঠি জ্বালি
আর প্রার্থনা করি—দেবতা আমার একটা গান হোক
পপলার বনে পাতা নড়ে
গাঁয়ের বাইরের টিলায় লাল রং ধরে
আমি তুষার চিতার পায়ের ছাপ থেকে কান্না ছেনে তুলি
আর আমি শব্দ খুঁজতে উলান বাটোরে
মায়া খুঁজতে জুয়ার টেবিলে
আমার ভেড়ার চামড়ার ডিল শব্দে ভরে ওঠে
আমি তদোগেন গিরতে শব্দর পাশে শব্দ সাজাই
আর তাকে কম্বলের তলায় নিয়ে শুই
তার দু’পায়েরফাঁকে উংলি করি
আর সে গানে সুর বসে
সেই গান সারাজ্যোৎস্না বরফের ওপর হেঁটে বেড়ায়
খুব ভোরে উলান বাটোরের রাস্তায় তার পায়ের ছাপ দেখা যায়
---
অনুবাদকের নোটঃ (ডিল=মঙ্গোল ট্রাডিশনাল পোষাক)
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৫
তথাগত তিনি করুণাময়
তথাগত তিনি তাঁর হাতের ছপটি
গুণেগুণে তিরিশবার আমার দাবনায়
তাঁর মূর্তির সামনে সে আমার ওপর উঠে পড়ে
আর করে আর করে আর করে
তার বোঁটা থেকে নুন বেরোয়
অথচ সমুদ্র এখান থেকে চারশো মাইল পুবে
চীনের জিনঝৌ আমি তদোগেন কখনো যাইনি
আমি এক বসন্তে ম্যানহাটানে গেছিলাম
নিউ ইয়র্কের মেয়েরা আমার ভাষা বুঝতে পারেনি
ওরা আমার পিঠের, দাবনার কালসিটে দেখতে চেয়েছিল
নিউ ইয়র্কের মেয়েদের রঙ বেগনী ওদের চুলের রঙ সবুজ
ওদের বুকে নুন নেই, তথাগত ওদের করুণা কর
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৬
আমি বল্লমে শান দিই
আমার মা হাড় ছাড়ানো বুদগের পেটের ভেতর
আরুলে মাখা টুকরো টুকরো ভেড়ার মাংস ভরে
ভেড়ার চর্বিতে খুশুর ভাজে
আর খসখসে গলায় গান করে
ধোঁয়া বেয়ে বেয়ে সে গান আকাশে উঠে যায়
সে গানের গন্ধে ঈগল ঝাঁপিয়ে পড়ে
আর ছিনতাই করে ভেড়ার মুন্ডু
সব্বার গান থাকে
বরফের নীচে মাটির একটা ঘুমঘুম গান
আলতাই পাহাড় আর আকাশের একটা দেখাশোনার গান
নদী আর নদীর মধ্যে থেকে শ্বাস নিতে ওঠা পাথরের গান
হাড়ের স্তুপকে আরপার করা বাতাসের একটা গান
সাম্পার পাঁজর থেকে
বেরিয়ে আসা গান
আমার বল্লমের ডান্ডায় থরথর করে
---
অনুবাদকের নোটঃ (বুদগ= একশ্রেণীর বড় কাঠবেড়ালি বা Marmot, আরুল= দই, খুশুর= ভাজা ডামপ্লিং, সাম্পা=নেকড়ে)
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৭
কে আর কাকে চেনে তদোগেন?
কন্দ কি চেনে তার উদ্ভিন্ন পাতাদের?
আমি তোমাকে কীইবা দেব?
চিরুনি বুলিয়ে দেব কাকচুলে
চিরুনি বুলিয়ে দেব ছাইচুলে
জট ছাড়িয়ে দেব
উকুন বেছে দেব
আর কালকের সবুজপাতা
আজকের হেমন্তে মাটিকে চিনলো
উটগুলো কুঁকড়েমুকড়ে বসে আছে
ওদের ছায়ার মতিগতি আমি বুঝতে পারি না
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৮
আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তুমি যখন দোরগোন হ্রদে ছিপ ফেল
আর বইয়ের শিরদাঁড়ায় হাত বোলাও
আনমনে আমি ঘাসের ওপর পাতা
কম্বল থেকে ছারপোকার মত উঠে আসি
৩৯-এএকলা জাপ সৈন্যের ক্ষমাপ্রার্থনার মত উঠে আসি
ওন্দোরহানের রাস্তায় আমি পিক-আপ চালাই
বার্চবনে পাতা উড়িয়ে যাই
তোমার থেকে এখন আমি ৫০০ মাইল দূরে
৭০০ মাইলের দিকে যেতে যেতে
পায়ের ফাঁকের শিরশিরানি ভাঁজ করে রাখি
আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তোমার চেয়ে কে’ইবাভালোজানে
যৌনতা ভাঁজ করে রাখলে বই হয়ে যায়
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৯
ঐ ছাই জিন্স আর বম্বার জ্যাকেটের
ছোকরা আমার কবিতা পড়ে না
ঐ নীল স্ট্রোলে রেশমি প্যাটার্নের
মেয়েটা আমার কবিতা পড়ে না
ঝানু তিরকিত আর তার আম্মা
আমার কবিতা পড়ে না
পীন বুকের কিরঘিজ ছুঁড়ি আদেলেত
সে ঘুড়ীর দুধ দোয়ায়
সে ঘুড়ীর দুধ গেঁজিয়ে আইগার বানায়
আমি সময়ে হেলান দিয়ে সাদা টোকো আইগার খাই
আর সকাল থেকে জোছনা অব্দি নেশা করি
কুচুটে ছুঁড়ি আদেলেত আমার কবিতা পড়ে না
আমি যেন সেই নিরক্ষর গান
মানুষের স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে
মানুষ হয়ে গেছি
আকাশ থেকে আমায় পেড়ে
মগজ থেকে আমায় পেড়ে
কেউ আর শুদ্রাগায় বসাচ্ছে না
---
অনুবাদকের নোটঃ (আইগার= ঘুড়ী (Mare)-এর দুধ থেকে প্রস্তুত মদ।শুদ্রাগা= তিন তার বিশিষ্ট বাজনা। জাপানি বাদ্যযন্ত্র শামিসেন-এর সাথে মিল আছে)
অনুবাদকের জবানিঃ
১৯৯৪, আমার তখন ২১। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। ২১ বছর যতটা বিশ্বাস পুষতে পারে আর যতটা হারাতে পারে ততোটাই আর কি। সঞ্জীব, সঞ্জীব ভক্ত গোলগাল ছোট্ট মানুষ মডার্ন বেকারি পেরিয়ে এক ভাড়া ঘরে থাকত। তার একতরফের প্রতিবেশী এক ছুকরি বেলজিয়ান আর অন্যতরফে এক মঙ্গোল বালক। সঞ্জীব, একদিন হাঁফাতে হাঁফাতেএসে অনামিকা বয়েজ হোস্টেলে সত্যর ঘরে সান্ধ্য আড্ডায়, চোখ বিস্ফারিত —“জানো সব্যদা সমস্ত মঙ্গোলিয়ানদের পাছায় একটা করে নীলদাগ আছে।মঙ্গোল বল্লো এইমাত্র”, চীনা, জাপানি, কোরিয়ানদেরও তাই। সে দাগ নাকি খোদ তেমুজিনের স্মৃতি, সারা পৃথিবীর তেমুজিনের বংশের উত্তরাধিকার। এরপরও মানুষে বিশ্বাস রাখা যায়? জেনেটিক ডাইলুশান বলেও কি কোনো জিনিস নেই? তো, সেই নাম না জানা মঙ্গোলের নাম হয়ে গেল নীলদাগ আর করোলারি হিসেবে বেলজিয়ান ছুকরির নাম লালদাগ।
১৯৯৮-এ আমি যখন কোরিয়ায়, তদোগেন-এর সাথে দেখা। মদ খেতে খেতে ঠাট্টার ছলে বলেই ফেললাম। তদোগেন সিরিয়াসলি বলল—“সেকী, তুমি দেখনি?” পরের দিন ডর্মিটরির কমিউনাল শাওয়ারে স্নান করতে করতে প্রথম বারের মত চারিদিকে চোখ বোলালাম। কী আশ্চর্য্য! সাদা তীব্র স্টেরাইল আলোয় কোথাও সাবানের ফেনা ভেদ করে, কোথাও জলধারা ফুঁড়ে সারি সারি কালসিটের মত নীলদাগ! সেই আবার মানুষের ওপর বিশ্বাস করতে শিখলাম, ২৫ বছর বয়সে যতটা বিশ্বাস করতে পারা যায় আর কী।
তারপর থেকেই তদোগেন-এর সাথে একটা সখ্য। মদ, গান, কোরিয়ান রকব্যান্ডের সাথে এখানে সেখানে। তদোগেন মান্দারিন জানে, রাশান জানে, কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়তে এসেছিল। কোরিয়ানও শিখে নিয়েছিল। আমার চেয়ে বছর ৬-এর বড় তদোগেন শান্ত, ধীর, মদ খেয়েও চুপ। “বুধা”বলে ডাকত কিম ইয়ং জুন, রকব্যান্ডের রাজা! কবিতা লিখত তদোগেন, কোনোদিন শুনিনি, ইংরেজি জানতনা। কোরিয়ান ভাষায় কবিতা বোঝার এলেম আমার ছিল না। ২০০২-এ যখন সে দেশ ছাড়ি, তদোগান তখনো কোরিয়ায়। আর তারপর জীবন। ১৩ বছর পর, ২০১৫য় ইয়ং জুন –এর কাছ থেকে মেল অ্যাড্রেস নিয়ে যোগাযোগ করে তদোগেন। তদোগেন এখন উলান বাটোর থেকে পুবে ওন্দোরহান শহরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। অ্যাদ্দিনে সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে তার মঙ্গোল কবিতা অনুবাদ করে, আমায় পাঠায়, আর আমি তাকে বাংলায় তুলে আনি। এ এমন একটা সময় যখন মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখব কী রাখব না—এই দ্বিধা নিয়েই দিন কাটে।
বে বী সা উ
একজন সাধক বসে আছেন। নদী এসে ধুয়ে দিচ্ছে সবুজ রঙ। শান্ত অথচ শান্ত না। ভুল নয় অথচ ঠিকও না। নক্ষত্রের পতনের শব্দ শুনতে পাইনি বলে একা বসে আছে বিষাদের মেঘ। বিষাদের! আনন্দের তবে। আনন্দম্। ঘন সবুজ সঙ্কেত পেরিয়ে নীল অসীম ছুঁতে চাওয়া এই আমি কী আমিই! নাকি জীবনের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে তারা খসার গল্প। রূপকথার রূপকে উঠে আসছেন ঠাকুমা। কথক হিসেবে তিনিই তখন আমাদের ভাগ্য বিধাতা। রাজপুত্রের জন্ম মৃত্যুর জীওনকাঠি মরণকাঠি যেন তাঁর হাতে। ইচ্ছে করলেই যেন তিন জীবনদান করতে পারেন আমাদের প্রিয় বীর রাজপুত্তুরকে আবার তাঁর ইচ্ছেতে থেমে আছে রাক্ষসের জন্মমৃতশোক। কিন্তু একটাই ভয় সমস্ত জনম মৃত্যুর নিশানা ভেঙে যদি জেগে উঠেন কবি! যদি আমাদের সমস্ত রূপকথার মাঝে টেনে আনেন তাঁর নটে গাছের শব্দখেলা। তখন থেকেই আমার ভয় কবিদের এই রাজত্বে। ঠাকুমাও যেন গুটিগুটি বালিকা হয়ে কবিকে সঁপে দিচ্ছেন তাঁর সমস্ত সত্ত্বা। তাঁর গল্প কথনের ভঙ্গিমা। একমনে আউড়ে চলেছেন
''আমার কথাটি ফুরাল
প্রবন্ধ
স র্ব জি ৎ স র কা র
খারাপ লাগার কথা ছিল
নিশ্চই কিন্তু তবু, আমার বেশ ভালই লাগলো। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। এই পরিণতি।
মৃত্যুই তো জীবনের শেষ ম্যাজিক শো। দর্শকেরা হল থেকে চলে যাওয়ার আগে। ছবিটা যেদিন
জন্ম নিয়েছিল সেদিন কেও একজন অনেক স্বপ্ন ভরে দিয়েছিল তার মধ্যে। সময়ের নিজস্ব
নিয়মেই সে সব স্বপ্ন তাদের জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল একদিন। মাটির থেকে
বিচ্ছিন্ন সব স্বপ্ন। খুব বেশি দিন বেঁচে থাকার কথাও নয় তাদের। যদিনা কেউ আবার
তাদের হাতে তুলে নিয়ে দেখতে চায় কোন একদিন। যদিনা, সেই ছবির ভেতরের রাস্তা ধরে কেউ
আবার, সেই সময়টাতে, সেই পরিবেশে, আর সেই মুহূর্তের অন্তরে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে
... করতে চায়। যদি না কেউ আর একবার নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে ফের পেইনটিং এর
ভেতরের ওই রাস্তাটা ধরে হাঁটে। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল এই ছবিটার। যেমন হয়ত, এই
লেখাটার নিয়তিও তাই হবে। ছিঁড়ে যাওয়া, ধুলো হয়ে যাওয়া, এটাই গ্রাস করে নেবে তাকে
একদিন।
গৌ র ব চ ক্র ব র্তী
দায়হীন
অথচ কথার কোনও দায় নেই শুধু আয়োজন
যে পথ ছেড়েছি সেই পথে, বাঁকে কখনও পাবে না
ধুলোর গন্ধ নেই আলোও স্বধর্ম থেকে চ্যুত
কতো আশকারা দেব? আর কতো লাই দেওয়া যায়?
যতোটা জেনেছি ভালো... যা কিছু জানি না, শ্রেয় বেশি
গোধূলির গায়ে ক্ষত চোখ তাতে মলম লাগায়
দূরত্ব খানিক বাড়া ভালো তবু কাছে এলে ক্ষতি
সময় খারাপ হলে প্রেম কোনও কাজেও আসে না
আমরা দুজনে চলো দূর থেকে চোখে রাখি ভ্রম
এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে ঢুকে যাবে গলা দিয়ে শ্বাস
তোমার নামের দলা উঠে এলে ঢোঁক গিলে ঢাকি
অথচ নামের কোনও দায় নেই--- শব্দটুকু ছাড়া…
সৌ
মা ভ
জ্যৈষ্ঠের কবিতা
১।
আমার
পরজন্মে লেগে পাকা জ্যৈষ্ঠের রঙ,
হাতপ্ত
রাস্তায় দাউদাউ গিরগিটির শ্মশানরঙের
লাল চোখের মত ফনীমনসার ছায়াযুদ্ধ, যেন
গ্রাফিক নভেলের পরাজিত সৈনিক।
২।
গ্রীষ্মের কাছে রঙ ভিক্ষে চায়
এশিয়ান
পেইন্টসের উজাড় কৌটো,
হসপিটাল
বেডে ভর্তি জলের শ্রাবণ শৈশব,
অনেকটা
রোদ চুরি জামার কোষ, ব্রেণের পকেটে,
রোদ
ভাঙ্গার খেলায় ভাঙ্গে আগুনের জলঅক্ষর
৩।
উনুনে
দুপুর ধরিয়ে দিল ফারেনহাইট জ্বলনাঙ্ক,
পুড়ছে
বুরবক জ্যৈষ্ঠের ঈশ্বর-নাভি, আর
একে
অপরের উচ্চতা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে,
জ্বরের
ভিতরে মেঘনাম জপতে জপতে আমরা
কয়েক
ডিগ্রি সেলসিয়াস জন্ম পেরিয়ে যাই।
রি য়া চ ক্র ব র্তী
আগুন নদী
সময়ের আলিঙ্গনে
মুহুর্মুহু শিহরিত।
আমিই ভরা বর্ষায়
অভিমানে ছলকে ওঠা নদী ।
হাতের মুঠোয় নেচে ওঠে
আমার রুক্ষ্ম সময়
আলো নই, অন্ধকারও নই
আমি সেই আগুন নদী
ছুঁয়ে এসেছি
সুদুর দক্ষিণ
দে ব রা জ চ ক্র ব র্তী
সহ্য ক্ষমতায় – ১১
তোমাকে ছোঁয়ার আগে অন্ধকার
এসে
পায়ের তলার মাটি নিয়ে চলে
গেছে
সরে গেছে সমস্ত পথ,
রাত্রি দূরত্ব বোঝে
জোনাকি পোকারাও
সুতো টেনে ধরে রাখা সম্পর্কের
মতো
ক্রমশ আরো নীল হতে হতে
উনুনের ধোঁয়ায় মিশেছে…
আমার দিগন্তরেখা
খুঁজেছো সন্ধ্যারতিতে
অক্ষর, লেখার ইতিহাসে?
অনুবাদ
তদোগেন গিরতের কবিতা
অনুবাদ স ব্য সা চী সা ন্যা ল
তদোগেন গিরতে পেশায় শিক্ষক। মঙ্গোলিয়ার ওন্দোরহান বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়ান। কবিখ্যাতি সেভাবে নেই। কোনো প্রকাশিত বই নেই। সময় কাটানোর জন্যই লেখালিখি করেন। তাঁর নিজের কথায়; “কবিতা নিয়ে সেরকম কোন অ্যাম্বিশন নেই। তা’ছাড়া আমার লেখাগুলি যে আদৌ কবিতা—মঙ্গোলিয়ার কোন দৈনিক বা পত্রিকা সে কথা স্বীকার করে না।“
*তদোগেন গিরতের কবিতা - ১
আমি নোংরা মেয়েদের কাছে যাব
কাঠের নথ নিয়ে যাব
আমার বাহুর মাংসে গিঁথে গোবি ভাল্লুকের দাঁত
আমার কোন নিষেধ নেই
আমি নোংরা মেয়েদের মুখের ভেতর
ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, আর কাঁপছি
কোঁচকানো মুখের চামড়া টান করে দিচ্ছি
আমার কোন নিষেধ নেই
ঘাসের মধ্যে উঠে দাঁড়াচ্ছে সারস
ওর চোখের পাতা লাল
ওর পিঠের রঙ কালো
চকচকে দুই দাবনার মাঝে সবচে মিষ্টি ওর পুটকি
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ২
আমার নাম তদোগেন গিরতে
তদোগেন গিরতে বলে কেউ নেই
আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌয়ের বোঁটা খুঁড়ে দিয়ে যায় কাক
আমি স্তেপ পেরিয়ে আর নদী পেরিয়ে
নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
আর দেখি ওর বিছানায় রাত্রি
আর দেখি ওর বিছানায় দু’পায় রাত্রিকে জড়িয়ে
বনশুয়োর
আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌ বলে কিছু নেই
আমি নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
পুরো মঙ্গোলিয়ায় কোন নোংরা মেয়েছেলে নেই।
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৩
সে সারাদিন তাইমেন মাছ কাটে
উবু হয়ে বসে ট্রাউট কাটে
ওর তলপেটে মাছের গন্ধ
আমরা দিনের বেলায় করি,
করার পর আমার তলপেট মাছ হয়ে যায়
রাতে যখন চিকচিক করে জল
আমার তলপেট বরফজলে সাঁতরে বেড়ায়
সে ভোরভোর তাকে খ্যাপলা জালে ধরে
আর কেটেকুটে বরফের ওপর রেখে দেয়
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৪
আমি পাল্লা বেড়ালের ধুমসো লোম
থেকে শব্দ বাছি
আমি আর্গালি ভেড়ার পেট কাটতে কাটতে
শব্দ তুলে আনি
আমি তথাগতর সামনে ধুপকাঠি জ্বালি
আর প্রার্থনা করি—দেবতা আমার একটা গান হোক
পপলার বনে পাতা নড়ে
গাঁয়ের বাইরের টিলায় লাল রং ধরে
আমি তুষার চিতার পায়ের ছাপ থেকে কান্না ছেনে তুলি
আর আমি শব্দ খুঁজতে উলান বাটোরে
মায়া খুঁজতে জুয়ার টেবিলে
আমার ভেড়ার চামড়ার ডিল শব্দে ভরে ওঠে
আমি তদোগেন গিরতে শব্দর পাশে শব্দ সাজাই
আর তাকে কম্বলের তলায় নিয়ে শুই
তার দু’পায়েরফাঁকে উংলি করি
আর সে গানে সুর বসে
সেই গান সারাজ্যোৎস্না বরফের ওপর হেঁটে বেড়ায়
খুব ভোরে উলান বাটোরের রাস্তায় তার পায়ের ছাপ দেখা যায়
---
অনুবাদকের নোটঃ (ডিল=মঙ্গোল ট্রাডিশনাল পোষাক)
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৫
তথাগত তিনি করুণাময়
তথাগত তিনি তাঁর হাতের ছপটি
গুণেগুণে তিরিশবার আমার দাবনায়
তাঁর মূর্তির সামনে সে আমার ওপর উঠে পড়ে
আর করে আর করে আর করে
তার বোঁটা থেকে নুন বেরোয়
অথচ সমুদ্র এখান থেকে চারশো মাইল পুবে
চীনের জিনঝৌ আমি তদোগেন কখনো যাইনি
আমি এক বসন্তে ম্যানহাটানে গেছিলাম
নিউ ইয়র্কের মেয়েরা আমার ভাষা বুঝতে পারেনি
ওরা আমার পিঠের, দাবনার কালসিটে দেখতে চেয়েছিল
নিউ ইয়র্কের মেয়েদের রঙ বেগনী ওদের চুলের রঙ সবুজ
ওদের বুকে নুন নেই, তথাগত ওদের করুণা কর
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৬
আমি বল্লমে শান দিই
আমার মা হাড় ছাড়ানো বুদগের পেটের ভেতর
আরুলে মাখা টুকরো টুকরো ভেড়ার মাংস ভরে
ভেড়ার চর্বিতে খুশুর ভাজে
আর খসখসে গলায় গান করে
ধোঁয়া বেয়ে বেয়ে সে গান আকাশে উঠে যায়
সে গানের গন্ধে ঈগল ঝাঁপিয়ে পড়ে
আর ছিনতাই করে ভেড়ার মুন্ডু
সব্বার গান থাকে
বরফের নীচে মাটির একটা ঘুমঘুম গান
আলতাই পাহাড় আর আকাশের একটা দেখাশোনার গান
নদী আর নদীর মধ্যে থেকে শ্বাস নিতে ওঠা পাথরের গান
হাড়ের স্তুপকে আরপার করা বাতাসের একটা গান
সাম্পার পাঁজর থেকে
বেরিয়ে আসা গান
আমার বল্লমের ডান্ডায় থরথর করে
---
অনুবাদকের নোটঃ (বুদগ= একশ্রেণীর বড় কাঠবেড়ালি বা Marmot, আরুল= দই, খুশুর= ভাজা ডামপ্লিং, সাম্পা=নেকড়ে)
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৭
কে আর কাকে চেনে তদোগেন?
কন্দ কি চেনে তার উদ্ভিন্ন পাতাদের?
আমি তোমাকে কীইবা দেব?
চিরুনি বুলিয়ে দেব কাকচুলে
চিরুনি বুলিয়ে দেব ছাইচুলে
জট ছাড়িয়ে দেব
উকুন বেছে দেব
আর কালকের সবুজপাতা
আজকের হেমন্তে মাটিকে চিনলো
উটগুলো কুঁকড়েমুকড়ে বসে আছে
ওদের ছায়ার মতিগতি আমি বুঝতে পারি না
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৮
আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তুমি যখন দোরগোন হ্রদে ছিপ ফেল
আর বইয়ের শিরদাঁড়ায় হাত বোলাও
আনমনে আমি ঘাসের ওপর পাতা
কম্বল থেকে ছারপোকার মত উঠে আসি
৩৯-এএকলা জাপ সৈন্যের ক্ষমাপ্রার্থনার মত উঠে আসি
ওন্দোরহানের রাস্তায় আমি পিক-আপ চালাই
বার্চবনে পাতা উড়িয়ে যাই
তোমার থেকে এখন আমি ৫০০ মাইল দূরে
৭০০ মাইলের দিকে যেতে যেতে
পায়ের ফাঁকের শিরশিরানি ভাঁজ করে রাখি
আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তোমার চেয়ে কে’ইবাভালোজানে
যৌনতা ভাঁজ করে রাখলে বই হয়ে যায়
*
তদোগেন গিরতের কবিতা- ৯
ঐ ছাই জিন্স আর বম্বার জ্যাকেটের
ছোকরা আমার কবিতা পড়ে না
ঐ নীল স্ট্রোলে রেশমি প্যাটার্নের
মেয়েটা আমার কবিতা পড়ে না
ঝানু তিরকিত আর তার আম্মা
আমার কবিতা পড়ে না
পীন বুকের কিরঘিজ ছুঁড়ি আদেলেত
সে ঘুড়ীর দুধ দোয়ায়
সে ঘুড়ীর দুধ গেঁজিয়ে আইগার বানায়
আমি সময়ে হেলান দিয়ে সাদা টোকো আইগার খাই
আর সকাল থেকে জোছনা অব্দি নেশা করি
কুচুটে ছুঁড়ি আদেলেত আমার কবিতা পড়ে না
আমি যেন সেই নিরক্ষর গান
মানুষের স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে
মানুষ হয়ে গেছি
আকাশ থেকে আমায় পেড়ে
মগজ থেকে আমায় পেড়ে
কেউ আর শুদ্রাগায় বসাচ্ছে না
---
অনুবাদকের নোটঃ (আইগার= ঘুড়ী (Mare)-এর দুধ থেকে প্রস্তুত মদ।শুদ্রাগা= তিন তার বিশিষ্ট বাজনা। জাপানি বাদ্যযন্ত্র শামিসেন-এর সাথে মিল আছে)
অনুবাদকের জবানিঃ
১৯৯৪, আমার তখন ২১। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। ২১ বছর যতটা বিশ্বাস পুষতে পারে আর যতটা হারাতে পারে ততোটাই আর কি। সঞ্জীব, সঞ্জীব ভক্ত গোলগাল ছোট্ট মানুষ মডার্ন বেকারি পেরিয়ে এক ভাড়া ঘরে থাকত। তার একতরফের প্রতিবেশী এক ছুকরি বেলজিয়ান আর অন্যতরফে এক মঙ্গোল বালক। সঞ্জীব, একদিন হাঁফাতে হাঁফাতেএসে অনামিকা বয়েজ হোস্টেলে সত্যর ঘরে সান্ধ্য আড্ডায়, চোখ বিস্ফারিত —“জানো সব্যদা সমস্ত মঙ্গোলিয়ানদের পাছায় একটা করে নীলদাগ আছে।মঙ্গোল বল্লো এইমাত্র”, চীনা, জাপানি, কোরিয়ানদেরও তাই। সে দাগ নাকি খোদ তেমুজিনের স্মৃতি, সারা পৃথিবীর তেমুজিনের বংশের উত্তরাধিকার। এরপরও মানুষে বিশ্বাস রাখা যায়? জেনেটিক ডাইলুশান বলেও কি কোনো জিনিস নেই? তো, সেই নাম না জানা মঙ্গোলের নাম হয়ে গেল নীলদাগ আর করোলারি হিসেবে বেলজিয়ান ছুকরির নাম লালদাগ।
১৯৯৮-এ আমি যখন কোরিয়ায়, তদোগেন-এর সাথে দেখা। মদ খেতে খেতে ঠাট্টার ছলে বলেই ফেললাম। তদোগেন সিরিয়াসলি বলল—“সেকী, তুমি দেখনি?” পরের দিন ডর্মিটরির কমিউনাল শাওয়ারে স্নান করতে করতে প্রথম বারের মত চারিদিকে চোখ বোলালাম। কী আশ্চর্য্য! সাদা তীব্র স্টেরাইল আলোয় কোথাও সাবানের ফেনা ভেদ করে, কোথাও জলধারা ফুঁড়ে সারি সারি কালসিটের মত নীলদাগ! সেই আবার মানুষের ওপর বিশ্বাস করতে শিখলাম, ২৫ বছর বয়সে যতটা বিশ্বাস করতে পারা যায় আর কী।
তারপর থেকেই তদোগেন-এর সাথে একটা সখ্য। মদ, গান, কোরিয়ান রকব্যান্ডের সাথে এখানে সেখানে। তদোগেন মান্দারিন জানে, রাশান জানে, কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়তে এসেছিল। কোরিয়ানও শিখে নিয়েছিল। আমার চেয়ে বছর ৬-এর বড় তদোগেন শান্ত, ধীর, মদ খেয়েও চুপ। “বুধা”বলে ডাকত কিম ইয়ং জুন, রকব্যান্ডের রাজা! কবিতা লিখত তদোগেন, কোনোদিন শুনিনি, ইংরেজি জানতনা। কোরিয়ান ভাষায় কবিতা বোঝার এলেম আমার ছিল না। ২০০২-এ যখন সে দেশ ছাড়ি, তদোগান তখনো কোরিয়ায়। আর তারপর জীবন। ১৩ বছর পর, ২০১৫য় ইয়ং জুন –এর কাছ থেকে মেল অ্যাড্রেস নিয়ে যোগাযোগ করে তদোগেন। তদোগেন এখন উলান বাটোর থেকে পুবে ওন্দোরহান শহরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। অ্যাদ্দিনে সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে তার মঙ্গোল কবিতা অনুবাদ করে, আমায় পাঠায়, আর আমি তাকে বাংলায় তুলে আনি। এ এমন একটা সময় যখন মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখব কী রাখব না—এই দ্বিধা নিয়েই দিন কাটে।
অনুবাদ
হি ন্দো ল ভ ট্টা চা র্য
বুলেট
শীতের বিকেল যেন, ধূসর কুয়াশা
সে জানে কেমন করে বিঁধে যেতে হয়
চোখের পলকে টাকা, পয়সা, যুদ্ধ, প্রেম
ঝলকে ঝলকে নেমে আসে।
সেতু
বিয়োগচিহ্ন, উদাসীন
হিংসা আর অসহায়তার মধ্যবর্তী
এ পার ও পারে
মুখোমুখি, বোবা।
যুদ্ধের
আগে…
পোস্টকার্ডের মত শুকনো মুখ, অক্ষরে মুক্তিকামী
নীরবতায় লেখা ঠিকানার দিকে চেয়ে থাকা
একটি মৃত্যুর থেকে, আরেকটি মৃত্যুর দিকে বেয়নেট বাড়ানো।
আগুন
যে যেভাবে পোড়ে, তাকে সেভাবে পোড়ায়।
নিজেও তো পোড়ে, চিরকাল।
আলো তাকে পোড়ায়, অন্ধকারে।
নশ্বরতা এভাবেই, নিজে অবিনশ্বর হয়ে যায়।
খিদে…
একটা রুটির জন্য ,
কফিন নিজেকে বয়ে নিজেই
মাটির ভিতর শুয়ে পড়ে।
একটা রুটির জন্য, মাথায় বন্দুক নিয়ে, দুটি ঠোঁট শুকনো চুম্বন।
একটা রুটির জন্য, শ্বাসরোধী গ্যাসচেম্বার, তুমিও স্বাগত।
প্রেম,
লিপস্টিক, সেলাইমেশিন
আমাদের শহরের একটি দোকানে, প্রিয়, বিক্রি হয় মন
তুমিও কিনতে পারো, যে যেখানে আছে, কিনে নাও।
দাম বাড়ার আগে, ঘরে ঘরে জন্ম নিক বাণিজ্যের শিশু।
আমাদের শহরের পয়সা হোক, খেতে পাক সকল দোকানি।
আয়রনি
যারা নিজেদের মাংস কেটে দিয়েচিল, তারা ফেরত চাইছে অস্ত্র
যেন প্রতিশোধের ভিতর আছে যন্ত্রণার উপশম
থমথম করে ট্রাকবোঝাই বারুদ এসে কড়া নাড়ছে-
আগুন জ্বালাও
হিংসা
একটি ফুলের মধ্যে দিয়ে চলে গেল যুদ্ধ
পড়ে থাকল পাপড়ি আর পরাগরেণু
তুমি দেখলে কিছু ঝরা
ফুল মাটির উপর
ভাবলে শীতকাল এসে গেছে
সমাধি
তারা প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে খুঁজে পেল একটি সুন্দর দেশ
সেখানে সীমান্ত ছিল না
আর ছিল নীরবতা
কারণ সেখানে জীবিত ছিল না কেউ
ঝড়
সে, তাকিয়ে রইল,
শব্দহীন
দৃশ্য তাকিয়ে রইল
শব্দহীন
নিশানা
গাড়িটা গড়িয়ে গেল রাতের বুকের কাছে
থমথম করে-
ছোঁ মেরে শিকার খুঁজল বাজ
সবাই দরজা বন্ধ করল, জানলাও
মৃত্যু নীরবে হাসল, যেন সে সব জানে।
যুদ্ধবিরতি
সাদা পতাকার মত, সে দাঁড়িয়ে রইল
কামানের সামনে
তখন গর্জন করছিল প্রতিহিংসা
আর দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে একজন ভাবছিল-
আবার ভালবাসার কথা।
সঙ্গীত
সৈনিকের কাছে চকলেটের মত মহান
আর গাছের কাছে হাওয়া
গায়ক তখন শ্রোতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে-
শ্রোতা, আকাশের দিকে
হিংসা
সে, অস্বীকার করল কেউ তাকে ভালবাসে
কারণ তার হৃদয়ে তখন বুলেট লেগে আছে
আর সে বুঝতে পারছে –
যে সম্পর্ক হয়নি কখনো, তার মৃত্যুও হয়
না।
শাসক
আসলে একটি বুলডোজার, যার ড্রাইভার বদল
হয়
রাস্তাও, শুনশান হয়ে যায় আকাশ
আর একটি বাড়ি থেকে জন্ম নেয় একটি যুদ্ধক্ষেত্র
শরত
জানি না বসন্ত আসবে কিনা, ভাঙা শহরে
মানুষ সেঁদিয়ে যাচ্ছে বাঙ্কারে
শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে আরেকটি ঠোঁট
ঝরে পড়ছে পাতা, ফুল, হেমন্তের দিকে
সংকেত
তারা আর্তনাদ করে উঠল,
শান্ত আঙুল রাখল মাটিতে
ঘুরে দাঁড়াল দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে
যেন বাঘ, একা বেঁচে আছে
আলোচনা
বে বী সা উ
তাঁবু মই আর আমি

''আমার কথাটি ফুরাল
নটে গাছটি মুড়াল
কেন রে নটে মুড়াস
গরু কেন খায়..."
"
চোখের পলকে এইযে ফুরাল শব্দটি কোথাও রচনা করে চলেছে বিশ্বচরাচরের আরম্ভকে। কোথাও বা শত সহস্র বছরের ঘুমকে ডেকে তুলে আনছে বাস্তবায়নের আঙ্গিকে। নিমগ্নগানে ওঠে বসেছেন কবি। ফুরালকে টানতে টানতে এসে পৌঁছেছেন অসীম আলোকে। দিশাহীন নীল প্যাস্টেলের রঙে তখন ভরে উঠছে ড্রয়িং রুমের আসবাব। ঋক্ মন্ত্রে ভরে আছে স্নেহ বিগলিত মায়ের কুমড়ো চারা। দুটি ভাতের জন্য কবিকে বললাম মাংসহত্যা নিষিদ্ধ এশহরে। এ শহরে কতদিন আঁশের গন্ধে কোন বালিকার মৃত্যু হয়নি। মৃদু হেসে কবি আঙুল তুললেন।
জল আর আগুনের গণ্ডি তে তখন ঈশানীয় মেঘ। পশ্চিমের আকাশে ভেসে উঠছে ধূসর মোষের ছবি। আঙুলের ছাপে স্পষ্ট দেখি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মর্ডাণ কুরুক্ষেত্র। ভীষ্ম জলের হাহাকারে ধর্মঘট জুড়েছেন রাজস্থানের বিস্তীর্ণ তালাও তে। কন্যাকুমারীর পথ চেনেন নি বলে কবি বেরিয়ে পড়েছেন চেন্নাই এয়ারপোর্টে। হাওয়া নড়ছে। বসন্তের দেশ পেরিয়ে দেখি মৃত বালিকার লাশে ভেসে উঠছে সদ্যজাত কোরকের গন্ধ আর আমি নত হয়ে বসে আছি সমস্ত অকাজের মধ্যে।
" বন্ধুটি গলায় দড়ি। অন্ধকার এই শালবনে
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গিলছে সর্প-হেন বুকসমান ভয়।
দেখছ না, অখন্ড নয়
ভাঙা মগজের রেখা ঝুঁকে আছে চন্দ্রস্থানে।
না, না --- এসব পাপ, সুকৃৎ এ দেহে
দেবতা থাকেন, তুমি এসো ---
এই যে শিংশপা গাছ, তার নীচে অমাবস্যা রাতে
আমরা বেঁচে উঠব ফের, এবং সেই থেকে
সাঁঝবাতির চন্দ্রস্থানে শুক্রচার্য বসতি করেন।"
পরিচয় নেই। ঠিকানাহীন হয়ে আমি চিঠির কাছে দাঁড়িয়েছি। সমস্ত একাকীত্বের দেওয়ালে খেলে বেড়াচ্ছে অকালের টিকটিকি। দেওয়াল এর কান নেই বলে আমার এই নিশ্চিত যাপন এক মুহূর্তে ভুল প্রমাণ করেছে রাজকীয় বাক্য। কবি মুচকি হাসছেন। ঝালাপালা এই হৃদয় নিয়ে অশান্ত হচ্ছি আরও। লক্ সিস্টেম, ব্লক অপশান পেরিয়ে বেরিয়ে পড়েছি পথে। তখনও কবির মৃদু হাসি। ঝনঝন নুপুর বাজিয়ে হেঁটে আসছে মহুলডাংরির জঙ্গল। দেউড়ির কাছে নত হওয়া শাসক বশ্যতা স্বীকার করে জানু পেতে আছে। ফিরে দেখি কবি নেই। কোথাও ঝুলিঝালা ছেড়ে পথে নেমেছেন। তুকতাকে মুছে দিচ্ছেন দেশকাল সীমাবদ্ধতা। থামাতে চাই। থামুন। কবি নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছেন ওই আলোকের পথে! আলো? না না আলো নয় ঠিক! অন্ধকার তো নয়ই।
" সাইকেল ও স্বর মিলিয়ে যায় রাস্তার বাঁকে।
এক বনভূমি--- ভাঙা কারখানা।
কানাভাঙা চাঁদ ঝুঁকে আছে অ্যাশশ্যাওড়ার রুগ্ন ডালে।
হে নির্বাণ, চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি সামনে দুর্গা অষ্টমী।"
কতদিন পরে তথাগত নেমেছেন পথে। কতদিনের পর আলো এসে ভরিয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের চোখ। এলাচের গন্ধ আসছে কবির রান্নার উঠোন থেকে। কালো কালিতে বুঝি আজকাল হৃৎপিণ্ড মিশে থাকে! উপাসনার মঞ্চ থেকে ক্ষীণ ধুঁয়োয় পরিবেশের ব্যেমো। খাদক মানুষ চেয়ে আছে সুজাতার দিকে। এখানেও বিরাট রাজনীতি। পায়েসের বাটিতে যে ধারাল আঁশের দাগ, থমথম করে উঠছে সমস্ত বাড়িটা। রাসমঞ্চ পেরিয়ে গীতার শ্লোকে ভরে আছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। হোমর্স নাইটগার্ডের চাকরি নিয়েছে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কে। ঠিক এই সময় ধরে বেরিয়ে এসেছেন কবি। বাড়ি ভর্তি গেস্ট। টাটকা মাছের বাজারে রিটামেন্ট কবি হাঁসফাঁস করে ওঠেন। এতদিন টাটকা টাই শেখা হয়নি তাঁর! এতদিন সঠিক মাছের খোঁজ পাননি! শুধু সঞ্জয় এর চোখে সমস্ত হারজিতের লড়াই। তখনই নড়ে ওঠে ভুঁইকুমড়োর ডাল, ফুল।
প্রথমে সে গল্পে ঢুকে পড়েছিল সাপ, মহান ক্ষমতা থেকে উঠে বসেছে আমীর খানের বিস্ফোট মন্তব্য সেই সময়টাতে আমি চুল শুকোচ্ছিলাম ব্যালকনীতে। বাজেট মন্তব্যে শ্বাস বন্ধ করে আছে প্রেসার কুকারের সিটি। আর তখনই হিটলার রাজ্য জয় করে ফিরছেন, কবি ছিলেন ঘুমিয়ে। বিকেলে তাঁর আনন্দ স্মারক। কবিতাও রেডি। ঘূর্নিঝড়ের মতো টেলিফোন এল ড্রাইভারের কাছ থেকে উড়ালপুলের যাতায়াতে মিশে গেছে নোনা রক্তের দাগ। নির্বাক চুপ। বাক পেরিয়ে নামছেন ঘরে। স্তর ভেদ করতে পারেননি বলে বাথরুমের দরজায় টাঙ্গিয়েছেন ওডিলিনের প্যাকেট। উল্লেখযোগ্য ভাবে সেদিনই জামশেদপুরে 144 ধারা। কারফিউ তে ভরে আছে মানগো ব্রীজ। স্নান সেরে ঘরে ফিরছেন গান্ধারী। চোখ বাঁধা। অন্ধকার।
" হে ছেঁড়া-ফাটা উনজীবন
মৃতরা মৃতদের কবর দিক। বনকলমীর বেড়া ডিঙিয়ে তোমাকে যেতে হবে অনেকটা পথ।
কিন্তু পা বাড়াতেই লুতাতন্তুতে আটকে যায় পা: যাও কোথায়?
আর ঠিক তক্ষুনি
রুদ্রাক্ষের মতো শব্দদের ডগ ফাটে এবং আদিত্য বর্ণের অক্ষর গুলি
জড়ো হয় আমার চারপাশে: "
অক্ষীগোলকের মতো চঞ্চল হচ্ছে প্রেম ভালোবাসা। কতদিন প্রিয়পুরুষ থেকে দূরে আছি। যৌনপিশাচের দল রাতভর উল্লাস করছে দলমার বুকে। জঙ্গল ভেদ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে হাতির শুঁড়। আমি নিমগ্ন হয়ে আছি শব্দের কাছে। মা বারবার তাড়া দিচ্ছেন ডিনারের। ডাইনিং টেবিলে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে কাটা চামচ। লবনের কৌটোতে মরিচের শুকনো দেহ। সুবর্ণরেখার মাঝি তখনই ফোন করে আমাকে। নতুনের আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি। মা রেখেছেন শনিবারের পুজো। বারবেলা ভাঙতে পারিনি বলে কবি চুপ আছেন। নির্দ্ধিধায় ভেঙে দিচ্ছেন আমার সমস্ত গোপন মিথ। এত নিষ্ঠুর তুমি কবি! এত নিষ্ঠুর! নিখুঁত খুনের হাত থেকে বেঁচে হাত বাড়াই বালিশের দিকে। দেখি নোনা জলে অবগাহন সেরে কবি তুলসী মালা জপছেন। আমি মৃদু হাসি এখন। এগিয়ে যাই কাঁচের টেবিলের দিকে। টেবিলময় থইথই নীলরঙের নাইট ব্লাব। স্বাগতম স্বপ্ন। আমার মেয়েজন্ম ভাসছে টেবিলময়।
"...
বারবার পরাস্ত হয় মানুষ। বৃষ্টিভেজা হাস্নুহানার কোনো গন্ধই আর বাঁচাতে পারে না তাকে।
অথচ প্রিয়তমার একটি মাত্র চুম্বনের জন্য
সে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল সমরকন্দের সমস্ত ঐশ্বর্য ।"
কাল চিহ্ন পেরিয়ে হেসে ওঠে আমার বায়বীয় সত্ত্বা। কবির সাথে আড়ি চলছে। কতদিন পরে শৈশব ফিরে এসেছে ঘরে। কবিকে ছুঁই নি কতদিন। তাঁবুঘর টাঙিয়েছেন কবি। সেখানেই বসবাস তাঁর। তুলসী মঞ্চে শাঁখ বাজান মা। আমি ঈষৎ ঝুঁকি তাঁর শব্দমালার দিকে। পরক্ষণে সরেও আসি। আলপথে ভ্রমণ ছড়িয়ে রাজনীতি করি শিক্ষক সমিতির। বেকারত্বের জ্বালায় নিভে আসে মন্থর সাপের বিষ। ঘুঙুর পায়ে চুপ থাকে ধানক্ষেত। সুর্বণরেখার জলে বান্ধবীর সিঁদুর ভাসছে। কোর্টে শেষ শুনানির দিন। ততন দিদির মেয়েটা বাংলা তো জানেইনা। চেহারাতেও আমেরিকার জৌলুস। ভাষা হারাক, শব্দ ব্যবহার। কতদিন কবি নেই। মোরামের পথ ভেঙে ছুটে আসি টেবিল ল্যাম্পের কাছে। দেখি, কবি মৃদু স্বরে কবিতা পাঠ করছেন। বাঁ'হাতে তাড়াচ্ছেন মশামাছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি চৌকাঠে। চাঁপাগাছের গন্ধে ঘরটা ভরে আছে।
উৎসব এলেই মনে হয় নির্জনতার প্রয়োজন। কোলাহল ছেড়ে, কথা ছেড়ে শুধু কিছু শব্দের কাছে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে অগ্নিদগ্ধ হৃদয়ের দায়ভার ভুলে সমস্ত অপারগতা তুলে ধরি পায়ের কাছে। হাঁটুর বয়েসী তারা, কামারশালার শুচি বস্ত্রে আত্মলাভ করুক। কতদিন সার সার কলসী সাজিয়ে রেখেছি, নাওয়া খাওয়া ভুলে সমর্পণ করেছি কোলাহলের কাছে। শুধু কিছু শব্দের জন্য বারবার নগ্ন হয়েছি। অথচ, কোথায় প্রেম, কোথায় বোধযুক্ত সুখী গৃহতন্ত্র। শুধু অপার ভুলের সীমানা ছাড়া কোন স্বাতন্ত্রতা নেই। নেই কোন বেশ্যা শব্দের শুদ্ধিকরণ। চুপচাপ সরে আসি। হাত পাতি কবির কাছে। বিষন্ন বালকের মতো বলেন--
" শব্দগুলি স্বরবর্ণের মতো নিজেদের পায়ে দাঁড়াক
এবং হয়ে উঠুক এক একটা রণ-পা
যেন সুখী গৃহস্থরা তাদের
ভয় পায়"
বুক ভর্তি শ্বাস তখন আমার। পটমদার ধূধূ প্রান্তর মাতাল হতে বসেছে। কোন সাধনা নেই, মুক্তি নেই অথচ শুধুমাত্র 'আনন্দম্' 'আনন্দম্'! সুর্বণরেখার তীরে বিস্তারিত কাশের জঙ্গল। মৃদু বাতাসে রুনুঝুনু নূপুরের তান। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে কচুবন। পা ফেলতেও ভয়। চিতি সাপ ভর্তি। সেখানেই একদিন বিড়ালের আঁচড় পাওয়া গেল। সবাই উৎসুক হয়ে। মুণ্ডু তুলে ধরেছেন প্রাচীনারা। ছুটু পিসির চোখে সেদিন কী ছিল! প্রেম নাকি জিঘাংসা! নাকি মুক্তি শুধু মুক্তি! বাবা মুখ তুলে চেয়েছিলেন আকাশের দিকে। তখন বুঝিনি---
' যেরকম আমিও একদিন চেয়েছিলাম বস্তুদের শূন্য খুঁড়ে/ আকাশের গায়ে তারাদের মতো শব্দদের গেঁথে দিতে।'
নেগেটিভ মুহূর্ত নিয়ে আমার যে বিরাট অহংকার ছিল, শব্দের বাষ্প ছটায় নিভে গেল বিবস্নানের শহর। শহরে নামলেই যেন অপার প্রশান্তি, বিকেলমেলার মাঠে জড়ো হচ্ছে শৈশব , মুক্তির অতীত। আমি চুপচাপ বসে বেঞ্চে। সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে চিত্র। ছোটবেলার। মুগ্ধ মনে দেখছি ছোটদের স্কেটিং। বাস্কেটবল। টেবিল টেনিস। হঠাৎই ধূঁয়াধার মেঘের বিপুল ভাবে আছড়ে পড়া। প্রাত্যহিক নশ্বরতাকে ভেঙে খলখলিয়ে উঠলেন প্রকৃতি। জলের স্রোতে ভাসল ছোটবেলা। শৈশবখানা। কবি ধরলেন কলম। কবিতা। আঁকলেন নশ্বর আলোকে বিগলিত করুণাধারা। সামনে আছড়ে পড়া জলের মাঝে কবির আনন্দমযাত্রা। আমি আরও একবার যেন ছুলাম তাঁকে। তিনিও যেন অপেক্ষা করছিলেন কখন ছুঁই তাঁর বোধকে। ভাবনাকে।
কিছু কিছু কবিতাতে সম্পূর্ণ ভাবে যেন আমি উঠে আসছি। আমিই যেন একোমবদ্বিতীয়ম। যেসব কথা লেখার সাধনায় উপাসনা এঁকেছি ঘর জুড়ে কত জন্ম আগে ছুঁয়ে গেছে সেসব শব্দের মাধুর্য। জলের কাছে গিয়ে বসি। কত শতাব্দীর ইতিহাস ঘেঁটে আমার কাছে এসেছে। মাটি চাপা অভিমানে মুখ তুলে দেখাচ্ছে সেই প্রাচীনতম পথ। মোবাইলের ফ্যাশ লাইটে ধরার চেষ্টা করি। যে পথ মিথ্যে দিয়ে গড়া, শতসহস্র বছরের তোপ ধ্বনি ' বাড়ন্ত মিথ্যার পাশে সত্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।' বান্ধবীর বানানো মিথ্যা নিয়ে পথ হাঁটি। ভাবি বাড়ুক আরো বাড়ুক। সমস্ত সত্য তখন হুড়মুড়িয়ে ঢুকবে এই শহরে। ভেঙে যাবে বালির বাঁধ, আত্মদহন। আর তখনই বসন্ত নামবে জামশেদপুরে, শহরে।
"ঐ শোনো---
বনিখেত ফরেস্ট বাংলোয় বৃষ্টি বাজছে টিনের ছাদে
যেন-বা রবিশঙ্করের কামেশ্বরী।
তুমি মাটি ও আকাশ হও আর চয়ন করো কায়া
যাদের শরীর নেই।
রাত্রিদের গান শোনায় নদী।
হে মধুক্ষরা জল
ওষধি ও বনস্পতিদের জন্য তুমি বহন করো শান্তি।
আমি ছড়-টান থামাইনি।
হরীতকীবনে গান গাইছে বউবসন্ত।
বাঁশের দণ্ড হাতে ঠুকঠাক হেঁটে যাচ্ছেন বৃদ্ধ
এবং কুমারীর হাতের কাঁকন ভেঙে ফেলছে শব্দের শূন্য।
তথাগত শূন্যবাদী নন। মৃত্যু ভেঙে দেয় রূপটান এবং মুক্ত করে জীবন।
আমি স্নান করে এসেছি সরস্বতী নদীর লুপ্ত জলে।
লাল পেড়ে কাপড় ও পাম্প-শু পরে
শব্দেরা হেঁটে যাবে ভাবমুখে। মশলার বটুয়া হাতে জীবনের বাড়ি।
জীবনের ছেলেমেয়ে আছে, ভাত- কাপড় । বোধিগাছ নেই।"
একাকীত্ব কী শুধুমাত্রই অভ্যেস একটা! অভ্যেস মানেই তো সাধনা। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে এগোই যাওয়া কোন এক স্বপ্নের দেশে। হ্যাঁ স্বপ্নই তো, মনের কুঠুরিতে পুষে রাখা সন্দর্পনে আলোক বিন্দু, কেউনা জানুক, ভাবুক তাইতো। কবিকে তবে হাঁটতে চেয়েছেন ওই গোপন কুঠুরির দিকে। যে কুঠুরি ছুঁয়েছে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের রথের চাকা, ভীষ্মের মুকুট অথবা ইলিয়াস থেকে উঠে আসা দেবীর স্তন। দৌড়ে গেছেন পরাশরের কাছে শব্দের মানে খুঁজতে আবার মায়ের কাছে বসেছেন বর্ণপরিচয়ের যুক্তাক্ষর খুলে। পাণিনি তখন চুপ করে হাসছেন। চুপ করে ভাবছেন, এইযে হেঁটে আসছে প্রস্তর যুগ, সেখানে কী সুশীতল জলের আভাস পিয়াস মেটাতে পারবে! বিষ্ণুপুরের রাসে ভাঙা বাঁশির সুর তো পিরামিডে নিজস্ব আত্মাকে দান করেছে তাঁর কবিতারা! একই আত্মতুষ্টি! নাকি হত্যা! হত্যা শব্দটি মানানসই হবে না কারন সবটুকু লেখা এসে পৌঁছেছে সাক্ষাৎ বর্তমানে--- যেখানে অতীতের মৃত্যুস্তুপ নেই নাকি ভবিষ্যতের ভুলভ্রান্তিময় আশা-নিরাশা। আর এখানেই আমার রান্নাঘর ঝনঝনিয়ে ওঠে আর কফির লোভে কাপে চুমুক দিই। আহা! বর্তমান!
সু জ ন ভ ট্টা চা র্য
গিলগামেষের মহাকাব্য
ছোটবেলা থেকে আমরা সবাইই শুনে আসি
পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য হল রামায়ণ আর আদিকবি হলেন বাল্মিকী। সেই সাথে এটাও আমাদের
জানা হয়ে যায়, পৃথিবীতে চারটি মহাকাব্য আছে। আমাদের রামায়ণ – মহাভারত বাদে
অন্যদুটি হল গ্রীসের ইলিয়াদ এবং অদিসি। চারটির মধ্যে দুটিই কিনা আমাদের মাটিতে
লেখা, ভাবলেই কেমন যেন গর্ব অনুভব হয়। সেই গর্বের আবহাওয়াকে আমরা মননের জমিতে
লালনপালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এস ওয়াজেদ আলি সেই যে লিখেছিলেন, “সেই ট্র্যাডিশন
সমানে চলিতেছে”, তার আলোকে আমাদের বুকও কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়ে ওঠে – দেখেছ,
মুসলমান হলেও ঠিক স্বীকার করে নিয়েছে।
একটা বিষয়ে সকলেই একমত যে কোন
মহাকাব্যই একজন কবির রচনা নয়। বিভিন্ন অনামা কবির কল্পনাতেই মহাকাব্যের প্রাথমিক
কাঠামো নির্মিত হয়। এবং গানের মাধ্যমেই সেই রচনা জনসমাজে পরিব্যাপ্ত হয়। নানান
সময়ে আরো বিভিন্ন কবি মূল কাঠামোর মধ্যে নিজস্ব শব্দ ঢুকিয়ে দেন। পরবর্তীকালে কোন
একজন কবি সেগুলিকে সংকলন করেন এবং তাঁকেই মহাকাব্যের স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়।
বাল্মিকীর রামায়ণে লবকুশের রামায়ণগানের উপাখ্যানে সম্ভবত সেই সত্যটাই লুকিয়ে
আছে।
পরবর্তীকালে গবেষকদের সিংহভাগ একমত হন
যে পৃথিবীর আদিতম মহাকাব্য হল ইলিয়াদ, যা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে
লিপিবদ্ধ হয়। অন্যদিকে রামায়ণ সংকলনের আনুমানিক সময় হল খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে
তৃতীয় শতক। যদিও অনেক ভারতীয় গবেষকই এই হিসাব মানেন না। তারা রামায়ণের রচনাকাল
হিসাবে খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীকেই ধরেন। কে প্রথম, এই বিতর্ক আজো হয়তো অব্যাহত
থাকতো, যদি না ইরাকে কতগুলো খোদাই করা পোড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হতো।
১৮৫৩ সালে ইরাকি প্রত্নতত্ত্ববিদ
হরমুজদ রসম ইরাকের মাসুল শহরের কাছে আসিরিয় সম্রাট আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারে
পোড়ামাটির ফলকগুলো আবিষ্কার করেন। ফলকগুলির উপরে কীলকাকার বর্ণমালায় প্রাচীন
সুমেরিয় ভাষায় খোদিত গিলগামেষ নামক এক রাজার কাহিনী। প্রাচীন সুমেরিয় লোকগাথা
অনুযায়ী গিলগামেষ ছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ২১০০ অব্দে উরুকের তৃতীয় উর রাজবংশের সন্তান।
রসম আবিষ্কৃত পোড়ামাটির ফলকগুলো খ্রীষ্টপূর্ব ১৮ শতাব্দীর নির্মাণ বলে দেখা যায়।
প্রায় কোন ফলকই সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি। এটিকেই গিলগামেষের মহাকাব্যের প্রাচীন
আক্কাদিয় বিবরণ বলে ধরা হয়।
পরবর্তীকালে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ
শতাব্দীর নবীন ফলকগুলি পাওয়া যায়। প্রাচীন ফলকে মহাকাব্যের নাম “সকল রাজাকে
অতিক্রম করে”। আর নবীন ফলকে নাম হলো “যিনি অজানাকে জেনেছিলেন”। গিলগামেষের
মহাকাব্যের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন জর্জ স্মিথ, ১৮৭০ সালে। এরপরে ইরাকের বিভিন্ন
অঞ্চল থেকে আরো কিছু ফলক আবিষ্কৃত হয়, যাদের বিবরণ মূল ফলকের থেকে খানিকটা আলাদা।
সবগুলোকে একত্রিত করে অ্যান্ড্রু জর্জ ২০০৩ সালে নতুন করে অনুবাদ করেন। এরপর
ইউনেস্কো গিলগামেষের মহাকাব্যকে বিশ্বের প্রাপ্তব্য মহাকাব্যগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম
বলে স্বীকৃতি দেয়।
নাম থেকেই বোঝা যায়, এই মহাকাব্যের
নায়ক গিলগামেষ। যাবতীয় মহাকাব্যের নায়করাই আজন্ম ত্রুটিহীন, মহৎ। অথচ গিলগামেষের
মহাকাব্যের সূচনাই হয় রাজা গিলগামেষের অত্যাচারের বিবরণ দিয়ে। গিলগামেষ
স্বেচ্ছাচারী, উদ্ধত, কামুক। নিজের প্রয়োজনে কাউকেই রেয়াৎ করে না সে। প্রতিকার
চেয়ে প্রজারা হাহাকার করে। সেই হাহাকারে দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। তারা সৃষ্টি করেন তার
সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী এক, নাম এনকিদু। অরণ্যে পশুদের মধ্যেই এনকিদু তার আশ্রয়
খুঁজে নেয়।
এনকিদুকে প্রথম দেখতে পায় এক শিকারী।
সে সংবাদ পৌঁছে দেয় গিলগামেষের কাছে। গিলগামেষ শিকারীকেই দায়িত্ব দেয় এক লাস্যময়ী
যুবতীকে ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে এনকিদুকে উরুকে নিয়ে আসার। যুবতীর শারীরি আবেদনে
এনকিদু বাঁধা পড়ে যায়। নারীটির সহগমন করে সে চলে আসে উরুকে। এনকিদু স্পর্ধাভরে
জানায় যাবতীয় রাজকীয় নিয়ম সে বদলে দেবে। গিলগামেষ আর এনকিদুর মধ্যে যুদ্ধ হয়।
গিলগামেষ টের পায় এই প্রথম সে তার সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। শেষে
রাজমাতা রিমাত-নিনসান এনকিদুকেও নিজের সন্তান বলে গ্রহণ করেন। গিলগামেষ আর এনকিদু
পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে।
এরপর দুজনে মিলে হত্যা করে
দেবদারুবনের ত্রাস হুমবাবাকে। দেবদারু বন থেকে কাঠ কেটে এনে উরুক নগরীকে সাজিয়ে
তোলে। গিলগামেষের প্রতাপে মুগ্ধ হয়ে কামদেবী ইসথার প্রেম নিবেদন করে। এনকিদুর
সাহচর্যে গিলগামেষ ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছে নতুন মানুষ। তাই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করে। আহত ইসথার দেবরাজ আনুর কাছে প্রতিকার চায়। ক্রুদ্ধ দেবরাজ স্বর্গের ষাঁড়কে
পাঠিয়ে দেন গিলগামেষকে শাস্তি দেবার জন্য। কিন্তু গিলগামেষ আর এনকিদু মিলে সেই
স্বর্গের ষাঁড়কেও হত্যা করে।
স্বর্গের ষাঁড়ের হত্যায় দেবতারা
ক্রুদ্ধ হন। তারা সিদ্ধান্ত নেন দুজনকেই শাস্তি দেবেন। সূর্যদেব শামাসের
হস্তক্ষেপে সিদ্ধান্ত হয়, এনকিদুকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই সিদ্ধান্তে এনকিদুর
মনে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দুজনে মিলে যে কাজ তারা করেছে, একা তাকেই কেন তার
দায় বহন করতে হবে! নিজেকে সে প্রতারিত মনে করতে শুরু করে এবং এমনকি গিলগামেষকেও
দোষারোপ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত উপবাসে এনকিদুর মৃত্যু হয়।
এনকিদুর মৃত্যুতে গিলগামেষ দু:খে ভেঙে
পড়ে। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সে একাই ঘুরে বেড়াতে থাকে অরণ্যে, পর্বতে। রাজবস্ত্রের
পরিবর্তে তার গায়ে ওঠে সিংহচর্ম। আর একদিন তার মনেও জেগে ওঠে মৃত্যুভয়। গিলগামেষ
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, মৃত্যুর থাবা থেকে কিভাবে নিজেকে চিরতরে সুরক্ষিত রাখা যাবে,
সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য সে যাবে উতানাপিস্তির কাছে। মহাপ্লাবনের সাক্ষী তিনি,
একমাত্র তিনিই জীবিত ছিলেন সেই ভয়াল প্লাবনের শেষে।
একের পর এক সমুদ্র পার করে গিলগামেষ
উপস্থিত হল উতানাপিস্তির কাছে। তার কাছে জানতে চাইল অমর হবার রহস্যবিদ্যা। উতানাপিস্তি
বললেন, মৃত্যু জীবনেরই আরেকটি রূপ। অনিবার্য সে। আর মৃত্যু আছে বলেই জীবন এত
সৌন্দর্যময়। মৃত্যু না থাকলে মানুষ জীবনের মহত্ত্ব বুঝতেই পারত না। মানুষ অমর হয়
মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়; জীবনে তার যা অর্জন তার জন্যই। প্রজ্ঞায় উপনীত
গিলগামেষ ফিরে আসে উরুকে, আবার নতুন করে জীবনচর্যা শুরু করবে বলে।
মৃত্যুভয় চিরন্তন। আর গিলগামেষের
মহাকাব্যের মূল সুর সেই মৃত্যুভয়কে কেন্দ্র করেই। এটি একমাত্র মহাকাব্য যা
মানুষের সেই অনাদিকালের আশঙ্কাকেই ধারণ করে রেখেছে। আর এভাবেই গিলগামেষের মহাকাব্য
হয়ে উঠেছে কালজয়ী।
গদ্য
শ মী ক ঘো ষ
‘বাইরেই থাকত, মাঝে মাঝে যেন ঘুরতে আসত বাড়িতে।’
রিকশা যাচ্ছে। এদিকে ওদেক ব্যস্ত মানুষ। বাস, অটো, সাইকেল।
রিকশা যাচ্ছে। আমার সামনে একটা কালো মাথা। রিকশাওয়ালার। কালো মাথার ওপরে নীল আকাশ।
কে যেন সাদা মেঘ গ্রেট করে করে ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা আকাশটায়। ছেঁড়া ছেঁড়া। অগরুর
গন্ধ নেই। ‘তবু মেঘ কেন করিডর জুড়ে?’
আমি যাচ্ছি তীর্থ করতে। তীর্থই তো। ৫ নম্বর লেখা পাঁচিলের
পাশে একটা বিরাট খোলা গেট। তার মধ্যে সাজানো ছিমছাম কয়েকটা বাড়ি। ঢুকে যাচ্ছি
হনহনিয়ে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রের মতো এবারও লেট। গেটের পাশে প্লাস্টিকের মেরুন
চেয়ারে বসা নীল জামা লোকটা প্রায় থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল। ‘কোথায় যাবেন?’
বললাম। মুহূর্তে চোখে কেমন একটা সমীহ। বাঁ দিকে দুনম্বর
বাড়ি।
‘পাট করা তোশক, শুধু তেল-কাপড় কলঘরে ছড়ানো-
ধোয়া হবে।
আবার জীবন এসে শুয়ে পড়বে সেই একই খাটে
মৃত্যুর অপেক্ষা করবে, কিংবা কিছু আমলকি কুড়িয়ে
যাবে বাড়ি।’
বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। বোধহয় আমি আসব বলেই। থমকে দাঁড়াই।
আমার ডানদিকে দরজার পাশে দুটো নাম। যাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব তিনি ওপরে। যিনি নেই।
তিনি নীচে।
নীচের জন অবশ্য সোজাসুজি দাঁড়িয়ে একদম সামনে। সেই প্রসারিত
কপাল। সেই ময়লা রঙ। সেই চশমা। ‘যে শিল্প ঐকিক নয়, তারে করো দান শূদ্রাণীরে/
চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে, যদি কারো/ সাধ্য থাকে! গালো পিত্ত, গালো চোখ,
বেটে করো কিমা।’
ভাবলাম অনেক হয়েছে। এইবার চলে এসেছি। এই যে এতটুকু এসেছে।
এতটুকু এনেছে আমাকে, এই যথেষ্ট। চলে যাই ফিরে। কিন্তু লোভ আছে। বেল দিলাম। তিতিদি
এলেন। বসলাম। আড়ষ্ট জবু থবু। ‘মানুষের মৃত্যু হলে তার ঘরে সে থাকে না খালি/ বাকি
সকলেই থাকে – যাবার সময় নয় কারো’ তিনি নেই। কিন্তু তিনি আছেন।
যাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম তিনি এলেন। ফরসা। নীল ছোপ
ছোপ সাদা শাড়ি। কালো ফ্রেমের চশমা। প্রথমে একটু আড়ষ্টতা। তারপর কথা বলতে শুরু
করলাম।
এই তিনি যিনি বাংলা ভাষার এক অলৌকিক কবিকে আগলে রেখেছিলেন।
আগলে রেখেছেন তাঁর লেখা তাঁর চলে যাবার পরেও। গবেষকের মতো খুঁজে খুঁজে তাঁর
লেখাগুলো খুঁজে বের করেছেন। অনেকটা পেরেছেন, অনেকটাই পারেননি। কারণ সেই কবি কবিতা
লিখতেন রেস্তোরাঁর ন্যাপকিনে, এখান ওখান থেকে তুলে নেওয়া কাগজে, লেখা ছাপতে দেবার
পর সেই পত্রিকা দিয়ে দিতেন অন্য কাউকে।
অথচ এই কবিতাই তাঁর অভীপ্সা। তাঁর সাধনা। এই কবিতা তিনি
লিখতে শুরু করেছিলেন খুব ছোট থেকে। অথচ শুরু করেছেন গোটা একটা উপন্যাস দিয়ে। তারপর
গল্প। তারপর কবিতা।
মানে উলটো পথে। প্রথমে ব্যাপ্তি, তারপর ছোট করে একদম শেষে
সংকেতে কথা বলছেন তিনি। এই সংকেতে কথাবলা, পদ্য ভাষায় কথা বলাই তাঁর চরম অভিষ্ট।
অথচ উপন্যাস তো আরো লিখেছেন তিনি। গল্পও লিখেছেন।
কেন? সেগুলো জোর করে লেখানো। দেশ পত্রিকার তরফ থেকে। কিন্তু
সেগুলো আর নাকি লিখতে চাইতেন না তিনি। বারংবার বলতেন ওই গদ্যের কামারগিরি আমি আর
করতে পারব না।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল ইংরাজি ভাষার এক অলৌকিক লেখকের কথা। তিনি
ছোটগল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন আবার উপন্যাসের প্রবল ব্যাপ্তিতেও থেকেছেন। তাঁর
গদ্য ভাষা সাংকেতিক। এত সাংকেতিক যে পড়ে বুঝে ফেলাই দুঃসাধ্য। অথচ তার কাব্য ভাষা
তুলনামূলক সহজ। বেশ সহজ। তিনি জেমস জয়েস।
অথচ এই কবি সম্পূর্ণ উলটো পথে হেঁটে তাঁর পদ্যভাষাটাকে
সম্পূর্ণ করায়ত্ত করার পর উদাসীন হয়ে গেলেন চিরকালের মতো।
নিজে সামান্য গদ্যভাষা লিখি বলে জানি, গদ্যকারের ব্যাপ্তি
লাগে। সে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে বড় আরো বড় লেখার জন্য। নিজেকে সে উজাড় করে
বিরাট লিখবে বলে। কত সময় এমন হয়েছে গল্প লিখব বলে প্রথম কয়েকটা অনুচ্ছেদ লেখার পর
আবার পড়ে বুঝেছি যে এটা গল্পের শুরু নয়। উপন্যাসের শুরু। ফেলে দিয়েছি। আর
পরমুহূর্তেই খুশি হয়েছি। আমার নিজের লেখা নিজে থেকে ব্যাপ্তি চাইছি। গল্পকার থেকে
ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া তাহলে বোধের অনেক গভীরে সঞ্জাত হয়েছে।
কিন্তু কাব্যভাষা? কাব্য ভাষা সে তো করায়ত্ত করতে পারিনি
কোনওদিন। একসময় আর চাইনিও আর। বারবার ভাষাকে ঠুকে নিয়ে লিখতে চেয়েছি আমার কথা।
আসলে একজন লেখকের ভাষা কী? যে ভাষায় সে আসলে তার নিজের সঙ্গে কথা বলে। যে ভাষা
একান্তই তার নিজস্ব লেখনিতে উঠে আসে। আর লেখার আগে বারবার যে ভাষায় সে নিজের সঙ্গে
নিজে কথা বলে ঝালিয়ে নেয়। কিন্তু গদ্যকারের তো আখ্যানের ছুতো লাগে। নিজেকে
প্রস্থিত করতে হয় অন্য চরিত্রে।
কবিরা অনেক ভাগ্যবান। আসলে তারা নিজের কথাই বলেন। নিজস্ব
বোধই বারংবার এনে হাজির করেন পাঠকের সামনে। তার ভাষা আসলে অনেক বেশি সুললিত। কারণ
নিজের কথা একদম নিজের মতো করে বলতে গেলে উপস্থাপনার সুষমা লাগে। নিজেকে বাঁচানোর,
নিজেকে আড়াল করার জন্য সংকেত লাগে।
কিন্তু যেকোনও ভাষাই, যেকোনও বোধই, এমনকি নিজস্ব বোধও তৈরি
করতে দীর্ঘ সাধনা লাগে। সেই সাধনার পরও একজন লেখক কী করে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যেতে
পারেন তাঁর লেখা নিয়ে?
নাকি সেটাই পরম প্রাপ্তি? সাধনার চরম পাহাড়টার চূড়ায়
পৌছোনোর পর নিরলম্ব উদাসীনতা।
তবে যে এত উন্নাসিকতা আমার, এত মায়া, নিজের লেখা নিয়ে, কেউ
ভালো বললে নিজের মধ্যে অনেকখানি হাসি, সে কী তবে? ব্যর্থতা? পাহাড়চূড়ায় না উঠতে
পারার আগেই পথভ্রষ্ট করা লোভ?
কথা চলে, কথার পর কথা চলে। প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ করি
তাঁকে। তিনি উত্তর দিয়ে যান একমনে। কিন্তু অক্ষরেরা তাড়িয়ে বেড়ায় ভেতর থেকে। কোন
অক্ষর? যে অক্ষররা আসলে লেখা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে ছায়া হয়ে খেলা করে মাথার
দুপাশে। শব্দ হওয়ার আগে। বাক্য হওয়ার আগে। বোধ। যে বোধ শব্দ খুঁজে নেবে।
যিনি পারেন তিনিই পারেন। আমি এখনও পারিনি।
বেরিয়ে আসি। কালচে ময়লা গলিটার দুপাশে কার্নিশ থেকে লাফ
দিয়ে নেমে আসে অসংখ্য কালো বিড়াল। বিড়াল নয় ওটা সন্ধ্যে। আকাশের গায়ে মেঘ নেই আর।
ঘন নীল কালচে হয়ে মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে।
ভেসে বেড়ানো অক্ষরগুলো হঠাৎ শব্দ হয়ে ওঠে। আমার নয় তাঁর
শব্দ।‘ মাইকেল মধূসূদনে’ সনেট উৎসর্গ করার শব্দে।
‘অগ্রাহ্য সান্ত্বনা, শুদ্ধ লোকায়তিকের উন্মোচনে-
কী পাবে? সাঁতার দাও, দর্পণে, লাফিয়ে পড়ো জলে।
আমি আজ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম
মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর ভাষাতেই যাঁর বাড়িতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘বাইরেই থাকত, মাঝে মাঝে
যেন ঘুরতে আসত বাড়িতে।’
অথচ তিনি সেই উদাসীন কবি হতে চাওয়া মানুষটাকে আগলে
রেখেছিলেন পরম মমতায়। বিষাদের যন্ত্রণা দিয়ে যাকে বড় করতে চাননি, বরং চরম উদাসীন
সেই মানুষটিকে নিমগ্ন থাকতে দিয়েছিলেন নিজস্ব সাধনায়। পরম মমতায়। পরম ভালোবাসায়।
হতে দিয়েছিলেন উলম্ব উন্মার্গগামী।
আর সেই বাড়ি থেকে আমি ধার করে নিয়ে এসেছি একটু বোধ। সেই বোধ
নিজের করে নিতে পারলে হয়ত একদিন আমিও লেখক হব।
‘কী পাবে? সাঁতার দাও, দর্পণে, লাফিয়ে পড়ো জলে।’
ধারাবাহিক গদ্য
রাংতায় আগুন ধরাও
১। একটি পেইনটিং এর জন্ম
ও মৃত্যু
রাংতায় আগুন ধরিয়ে দাও।
ধারালো চাঁদের মত, মাটির গোপন আঁধারে।
একটা গোটা জীবন কাটাও এভাবেই
একটা সম্পূর্ণ জীবন
রাংতায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে...
যাতে তোমার আত্মাকে
কেউ পোড়াতে না পারে ।
গত কয়েকদিন ধরে এই ছবিটার কথা ভেবেছি। সাদা
ক্যানভাসের ওপর যখন মাস্কিং টেপ লাগাচ্ছিলাম, প্রথমে আড়াআড়ি একটু চওড়া করে
ক্যানভাসের মাঝখান অবধি, তারপর কয়েকটা সরু টেপ লম্বালম্বি সেটার নিচের থেকে
ক্যানভাসের শেষ মাথায়, তখনি কয়েকটা ভাঙা টিনের চালের ছাদ আবছা ভাবে দানা বাঁধছিল
মনে। একটি দৃশ্য তার বাস্তবতা পেরিয়ে দিন ভাঙে, রাত পেরোয়, তার পর কখন কী ভাবে
স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ে তার স্পষ্ট উত্তর কিছু নেই। মাইমেসিস যাই প্রমাণ করতে চাক না
কেন ঘটনা হচ্ছে দৃশ্য ও তার প্রতিরূপ এর মাঝখানে অনেক ফাটল, অনেক ক্ষত, অনেক ছেদ,
সময়ের নিয়মেই দেখা দিতে থাকে। অন্ধকার, বিপন্ন বাতাস, দেবদারু পাতাদের নিস্তব্ধতা
লেগে থাকে তাদের ফাঁকে ফোকরে।
চালসায় দেখেছিলাম সে দৃশ্য। টিনের চালের
বাড়িঘরের আড়ালে পাহাড়ের আবছা রেখা, তার মাথায় ধূসর হলুদ চাঁদ জ্যোৎস্নার চাদর
বিছিয়ে দিচ্ছে।
ছবিতে মাস্কিং টেপ লাগালাম, সাদা স্পেস
ছাড়লাম, কিন্তু তখনো জানিনা কী হয়ে উঠছে। তবু এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চলা এটাই ভাল
লাগে আমার। হাঁটতে হাঁটতে সব কিছু ফুটে উঠবে ক্রমশ । মাস্কিং টেপ আর তার পাশের
সাদা জায়গাটার ওপর প্রুশিয়ান ব্লু মেশানো কালো রঙ লেপে দিলাম এবার। চকচক করে উঠছিল
জায়গাটা। যেন এবার ও কিছু বলতে চায়। যেন অতীতের কোন দিনকে একই সাথে দু হাত দিয়ে
ঠেলে আটকে রাখতে চাইছে, আর একই সাথে
চাইছে, তার নিজের কালোকে ছিঁড়ে খুঁড়ে সেটা বেরিয়ে আসুক সামনে। ক্যানভাসের
বাকি সাদা অংশ তখনও বোবা, অভিব্যাক্তিহীন।
তিনদিন আগে ছবিটা যখন শুরু করেছিলাম তখন রাত
দেড়টা। আর আজ সকাল দশটায় দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের ওপর জানলা দিয়ে
রোদ্দুর এসে পরেছে। কালো রঙয়ের ওপর রোদের আলো প্রতিফলিত হয়ে জায়গাগুলো চকচক করছে
ফের। এখন যেন কথা বলার জন্যে প্রস্তুত তারা। ঠিক হঠাৎ রাস্তায় পুরনো বন্ধুর সাথে
দেখা হয়ে গেলে ঠোঁটে খেলে যাওয়া মুগ্ধ হাসির মত হাসি লেগে আছে তাদের চোখে মুখে।
অথচ সেদিন রাতে মাস্কিং টেপগুলো নিয়ে আর
নাড়া চাড়া করিনি। বুকের ওপর কালো রঙ নিয়ে তারা ওভাবেই পড়ে ছিল সারারাত। তিন পেগ
রাম খেয়েছিলাম সে রাতে। ক্যানভাসের সাদা স্পেস ছেড়ে রেখেছিলাম যেমন ছিল তারা
সেভাবেই। রঙ, বর্ণ, নির্বাচন করবার আমি তো কেউ নই। ওরাই জানে ওরা কোন রঙএ প্রকাশ
পেতে চায়। রাত চারটে অবধি চুপচাপ বসে ছিলাম ছবিটার দিকে তাকিয়ে। ঠিক কি যে
ভাবছিলাম এখন আর মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, ‘ভাঙাচোরা’ শব্দটা কী ভাবে যেন
গেঁথে গিয়েছিল মাথার ভেতরে।
একটা কাল্পনিক সংলাপ মনে আসছে এখন।
-
বিলি জোয়েল এর গান শুনেছো?
কফির কাপে চামচ নাড়তে
নাড়তে জিগেস করি তাকে।
-
পিয়ানোম্যান?
-
হ্যাঁ।
-
ওখানে একটা লাইন আছে অনেকটা
এইরকম।
-
“এখন তারা একটা ড্রিংক শেয়ার
করে নিচ্ছে যার নাম ‘একাকীত্ব’”
-
“ তবে একা একা পান করার থেকে
সেটা খাওয়া অনেক ভাল”। এটা তার পরের লাইন, তাই তো?
বাইরে থেকে রোদ্দুর এসে ক্যানভাসের নিচের
দিকটায় প্রায় ফ্যাকাশে একটা আলো তৈরি করেছে। কালো রঙএর মাস্কিং টেপ এর ওপর কিছুটা
সাদা কিছুটা ক্রোমিয়াম ইয়ালো ছড়িয়ে দিই। তারা বাইরেও কিছুটা ছড়িয়ে যায়। ক্যানভাসের
ওপর দিকের সাদা অংশ এখনো ছায়ায় ঢাকা। কিছুটা কোবাল্ট ব্লু হালকা করে বুলিয়ে দিই
ওদের ও্পরেও। এতক্ষনে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, নিজেদের গল্পগুলো
ওরা এবার বলে দিতে চাইছে। আর ওদের আটকে রাখা যাচ্ছেনা। কিন্তু কি বলতে চাইছে ওরা?
এখনো যে সব সাদা জায়গা পড়ে আছে ক্যানভাসে, এখন যারা বাইরে মেঘ করে আসায় আর একটু
ছায়াছন্ন হয়ে এল, না, আমি এখনও সম্পূর্ণ ধরতে পারিনি ওদের কথা।
কিন্তু একটা কিছু আছে যা আমাকে প্রবলভাবে
টানছে ওদের দিকে। একবার মনে হল ধারালো স্প্যাচুলাটা দিয়ে কয়েকটা নির্মম আঁচড় দিই
ওদের গায়ে। আঘাতের পর আঘাতে যদি ওরা ওদের গল্প শুরু করে। সে সব কাহিনি আমার নিয়তি
না পরিত্রাণ আমি জানিনা! কিন্তু এ ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই আমার।
কিন্তু তারপরেই মনে হল, এভাবে কি কথা বলানো
যায় কাউকে? যায়না তো।
মানুষ কে না। ছবিকেও না। তবু ছবিটা নিজে
থেকেই হয়ে উঠল একসময়। যদিও শেষ করার পরে বুঝিনি যে সে আরও কিছু বলতে চাইবে আমাকে।
অন্য কোনদিন। অন্য কোনখানে।
গতকাল
ও বাড়ি গিয়েছিলাম। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই গলি। তারপর বাড়ির মেইন দরজা। গলির একপাশে
টানা লম্বা পাঁচিল । একসময়ে বাবা খুব শখ করে এই পাঁচিল বরাবর অনেক ফুলের গাছ
লাগিয়েছিল। বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। সে সব গাছে এখন আর কেও জল দেয়না।
পরিচর্যাও করেনা । গাছ বড় অভিমানী প্রাণ । যত্ন ছিলনা, তাই এই পাঁচ বছরে সেগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। মাটি শক্ত হয়ে গেছে অনেক। ফেটে
ফেটে গেছে জায়গা জায়গায়। আশ্চর্য ব্যাপার তারি মধ্যে একটা বকুল গাছ কী ভাবে যেন
জীবন খুঁজে পেয়ে গেল। টান টান দাঁড়িয়েও থাকলো সোজা। এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। প্রায়
দোতলা সমান। মাঝেমাঝে তার ঝাঁকড়া পাতা ছেঁটে দিতে হয়। গতকাল গিয়ে দেখি, সেই শুকিয়ে যাওয়া টানা মাটির বাঁধানো জায়গাটায়, ওই
বকুল গাছটার গোড়ায় একটা ছোট ছবির ক্যানভাস উল্টোমুখে পড়ে আছে। ছবিটা দেখা যাচ্ছেনা,
শুধু তার কাঠের ফ্রেমের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। ছবির ক্যানভাসটা
নিচের বাঁ দিক থেকে ডানদিকে ওপরের কোনা অবধি বেশ কিছুটা ফালা করা। সেই জায়গায়
ক্যানভাসের কাপড় কেমন শিথিল হয়ে ঝুলে আছে। ছবিটা, কি মনে হল,
সোজা করে দেখতে ইচ্ছে করলো। দেখি আমারই আঁকা একটা ছবি। সেই
চালসা থেকে ফিরে যে ছবিটা অয়েলে এঁকেছিলাম, সেইটা। কালো নীল
আকাশের মাঝে কয়েকটা বাড়ির ঢালু ছাদ আর তাদের টিনের চালের ওপর দিয়ে চাঁদের ছায়া
গড়িয়ে নেমেছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূরের ধূসর নীল পাহাড়ের আভাস। সেই ছবিটাই।
ছেঁড়াখোঁড়া ক্যানভাসের ফেলে দেওয়া, ধুলো মাখা বুকের ভেতর,
পাহাড়ের ছায়া মেখে, এখনো যেন কোন বিস্ময়ের মত
দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনো তার রঙ বেশ উজ্বল; এখনো তার কোবাল্ট
ব্লু আকাশের মাঝে ঝাপসা সাদা পাহাড়ের রেখা স্পষ্ট দেখা যায়।
ছবিটাকে লোকে ফেলে দিয়ে
গেছে। বাড়ির লোকেরাই। ছেঁড়া একটা ছবি। জঞ্জাল ছাড়া আর কী! জায়গা আটকে রাখা শুধু
শুধু।

আর ততদিন, তার জীবনকালে,
যে চাইছে, শুধু সেই দেখতে পাবে, এই ছবির, এই লেখার, এই কথাগুলোর অন্তর্লীন ম্যাজিক
শো, যা শুধু পূর্ণতার কথাই বলে, বলতে চায়। বলতে চায়, শ্বাসরোধী সব অপূর্ণ মিলনের
কথাও। এই তো তার কুহকী বিদ্যা। তার জাদু। তার মায়াপৃথিবীর আবহমান ম্যাজিক। জীবনের
আর তার মৃত্যুরও।
বাকি সব কিছুই আসলে তো,
জীবিত মানুষের অবহেলা আর ধুলোর অন্তহীন খেলা।
লেখা পাঠাবেন অভ্রতে লিখে ওয়ার্ড ফাইলে। আমাদের আগামী ব্লগ সংখ্যা ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭
Comments
Post a Comment