Skip to main content

যে শিল্প ঐকিক নয়, তারে করো দান শূদ্রাণীরে-- গদ্যে শমীক ঘোষ

গদ্য

শ মী ক ঘো ষ

যে শিল্প ঐকিক নয়, তারে করো দান শূদ্রাণীরে



‘বাইরেই থাকত, মাঝে মাঝে যেন ঘুরতে আসত বাড়িতে।’
রিকশা যাচ্ছে। এদিকে ওদেক ব্যস্ত মানুষ। বাস, অটো, সাইকেল। রিকশা যাচ্ছে। আমার সামনে একটা কালো মাথা। রিকশাওয়ালার। কালো মাথার ওপরে নীল আকাশ। কে যেন সাদা মেঘ গ্রেট করে করে ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা আকাশটায়। ছেঁড়া ছেঁড়া। অগরুর গন্ধ নেই। ‘তবু মেঘ কেন করিডর জুড়ে?’
আমি যাচ্ছি তীর্থ করতে। তীর্থই তো। ৫ নম্বর লেখা পাঁচিলের পাশে একটা বিরাট খোলা গেট। তার মধ্যে সাজানো ছিমছাম কয়েকটা বাড়ি। ঢুকে যাচ্ছি হনহনিয়ে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রের মতো এবারও লেট। গেটের পাশে প্লাস্টিকের মেরুন চেয়ারে বসা নীল জামা লোকটা প্রায় থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল। ‘কোথায় যাবেন?’
বললাম। মুহূর্তে চোখে কেমন একটা সমীহ। বাঁ দিকে দুনম্বর বাড়ি।
‘পাট করা তোশক, শুধু তেল-কাপড় কলঘরে ছড়ানো-
ধোয়া হবে।
আবার জীবন এসে শুয়ে পড়বে সেই একই খাটে
মৃত্যুর অপেক্ষা করবে, কিংবা কিছু আমলকি কুড়িয়ে
যাবে বাড়ি।’

বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। বোধহয় আমি আসব বলেই। থমকে দাঁড়াই। আমার ডানদিকে দরজার পাশে দুটো নাম। যাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব তিনি ওপরে। যিনি নেই। তিনি নীচে।
নীচের জন অবশ্য সোজাসুজি দাঁড়িয়ে একদম সামনে। সেই প্রসারিত কপাল। সেই ময়লা রঙ। সেই চশমা। ‘যে শিল্প ঐকিক নয়, তারে করো দান শূদ্রাণীরে/ চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে, যদি কারো/ সাধ্য থাকে! গালো পিত্ত, গালো চোখ, বেটে করো কিমা।’

ভাবলাম অনেক হয়েছে। এইবার চলে এসেছি। এই যে এতটুকু এসেছে। এতটুকু এনেছে আমাকে, এই যথেষ্ট। চলে যাই ফিরে। কিন্তু লোভ আছে। বেল দিলাম। তিতিদি এলেন। বসলাম। আড়ষ্ট জবু থবু। ‘মানুষের মৃত্যু হলে তার ঘরে সে থাকে না খালি/ বাকি সকলেই থাকে – যাবার সময় নয় কারো’ তিনি নেই। কিন্তু তিনি আছেন।
যাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম তিনি এলেন। ফরসা। নীল ছোপ ছোপ সাদা শাড়ি। কালো ফ্রেমের চশমা। প্রথমে একটু আড়ষ্টতা। তারপর কথা বলতে শুরু করলাম।
এই তিনি যিনি বাংলা ভাষার এক অলৌকিক কবিকে আগলে রেখেছিলেন। আগলে রেখেছেন তাঁর লেখা তাঁর চলে যাবার পরেও। গবেষকের মতো খুঁজে খুঁজে তাঁর লেখাগুলো খুঁজে বের করেছেন। অনেকটা পেরেছেন, অনেকটাই পারেননি। কারণ সেই কবি কবিতা লিখতেন রেস্তোরাঁর ন্যাপকিনে, এখান ওখান থেকে তুলে নেওয়া কাগজে, লেখা ছাপতে দেবার পর সেই পত্রিকা দিয়ে দিতেন অন্য কাউকে।
অথচ এই কবিতাই তাঁর অভীপ্সা। তাঁর সাধনা। এই কবিতা তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন খুব ছোট থেকে। অথচ শুরু করেছেন গোটা একটা উপন্যাস দিয়ে। তারপর গল্প। তারপর কবিতা।
মানে উলটো পথে। প্রথমে ব্যাপ্তি, তারপর ছোট করে একদম শেষে সংকেতে কথা বলছেন তিনি। এই সংকেতে কথাবলা, পদ্য ভাষায় কথা বলাই তাঁর চরম অভিষ্ট। অথচ উপন্যাস তো আরো লিখেছেন তিনি। গল্পও লিখেছেন।
কেন? সেগুলো জোর করে লেখানো। দেশ পত্রিকার তরফ থেকে। কিন্তু সেগুলো আর নাকি লিখতে চাইতেন না তিনি। বারংবার বলতেন ওই গদ্যের কামারগিরি আমি আর করতে পারব না।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল ইংরাজি ভাষার এক অলৌকিক লেখকের কথা। তিনি ছোটগল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন আবার উপন্যাসের প্রবল ব্যাপ্তিতেও থেকেছেন। তাঁর গদ্য ভাষা সাংকেতিক। এত সাংকেতিক যে পড়ে বুঝে ফেলাই দুঃসাধ্য। অথচ তার কাব্য ভাষা তুলনামূলক সহজ। বেশ সহজ। তিনি জেমস জয়েস।
অথচ এই কবি সম্পূর্ণ উলটো পথে হেঁটে তাঁর পদ্যভাষাটাকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করার পর উদাসীন হয়ে গেলেন চিরকালের মতো।
নিজে সামান্য গদ্যভাষা লিখি বলে জানি, গদ্যকারের ব্যাপ্তি লাগে। সে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে বড় আরো বড় লেখার জন্য। নিজেকে সে উজাড় করে বিরাট লিখবে বলে। কত সময় এমন হয়েছে গল্প লিখব বলে প্রথম কয়েকটা অনুচ্ছেদ লেখার পর আবার পড়ে বুঝেছি যে এটা গল্পের শুরু নয়। উপন্যাসের শুরু। ফেলে দিয়েছি। আর পরমুহূর্তেই খুশি হয়েছি। আমার নিজের লেখা নিজে থেকে ব্যাপ্তি চাইছি। গল্পকার থেকে ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া তাহলে বোধের অনেক গভীরে সঞ্জাত হয়েছে।
কিন্তু কাব্যভাষা? কাব্য ভাষা সে তো করায়ত্ত করতে পারিনি কোনওদিন। একসময় আর চাইনিও আর। বারবার ভাষাকে ঠুকে নিয়ে লিখতে চেয়েছি আমার কথা। আসলে একজন লেখকের ভাষা কী? যে ভাষায় সে আসলে তার নিজের সঙ্গে কথা বলে। যে ভাষা একান্তই তার নিজস্ব লেখনিতে উঠে আসে। আর লেখার আগে বারবার যে ভাষায় সে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে ঝালিয়ে নেয়। কিন্তু গদ্যকারের তো আখ্যানের ছুতো লাগে। নিজেকে প্রস্থিত করতে হয় অন্য চরিত্রে।
কবিরা অনেক ভাগ্যবান। আসলে তারা নিজের কথাই বলেন। নিজস্ব বোধই বারংবার এনে হাজির করেন পাঠকের সামনে। তার ভাষা আসলে অনেক বেশি সুললিত। কারণ নিজের কথা একদম নিজের মতো করে বলতে গেলে উপস্থাপনার সুষমা লাগে। নিজেকে বাঁচানোর, নিজেকে আড়াল করার জন্য সংকেত লাগে।
কিন্তু যেকোনও ভাষাই, যেকোনও বোধই, এমনকি নিজস্ব বোধও তৈরি করতে দীর্ঘ সাধনা লাগে। সেই সাধনার পরও একজন লেখক কী করে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যেতে পারেন তাঁর লেখা নিয়ে?
নাকি সেটাই পরম প্রাপ্তি? সাধনার চরম পাহাড়টার চূড়ায় পৌছোনোর পর নিরলম্ব উদাসীনতা।
তবে যে এত উন্নাসিকতা আমার, এত মায়া, নিজের লেখা নিয়ে, কেউ ভালো বললে নিজের মধ্যে অনেকখানি হাসি, সে কী তবে? ব্যর্থতা? পাহাড়চূড়ায় না উঠতে পারার আগেই পথভ্রষ্ট করা লোভ?
কথা চলে, কথার পর কথা চলে। প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ করি তাঁকে। তিনি উত্তর দিয়ে যান একমনে। কিন্তু অক্ষরেরা তাড়িয়ে বেড়ায় ভেতর থেকে। কোন অক্ষর? যে অক্ষররা আসলে লেখা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে ছায়া হয়ে খেলা করে মাথার দুপাশে। শব্দ হওয়ার আগে। বাক্য হওয়ার আগে। বোধ। যে বোধ শব্দ খুঁজে নেবে।
যিনি পারেন তিনিই পারেন। আমি এখনও পারিনি।
বেরিয়ে আসি। কালচে ময়লা গলিটার দুপাশে কার্নিশ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আসে অসংখ্য কালো বিড়াল। বিড়াল নয় ওটা সন্ধ্যে। আকাশের গায়ে মেঘ নেই আর। ঘন নীল কালচে হয়ে মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে।
ভেসে বেড়ানো অক্ষরগুলো হঠাৎ শব্দ হয়ে ওঠে। আমার নয় তাঁর শব্দ।‘ মাইকেল মধূসূদনে’ সনেট উৎসর্গ করার শব্দে।

‘অগ্রাহ্য সান্ত্বনা, শুদ্ধ লোকায়তিকের উন্মোচনে-
কী পাবে? সাঁতার দাও, দর্পণে, লাফিয়ে পড়ো জলে।

আমি আজ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর ভাষাতেই যাঁর বাড়িতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়  ‘বাইরেই থাকত, মাঝে মাঝে যেন ঘুরতে আসত বাড়িতে।’
অথচ তিনি সেই উদাসীন কবি হতে চাওয়া মানুষটাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। বিষাদের যন্ত্রণা দিয়ে যাকে বড় করতে চাননি, বরং চরম উদাসীন সেই মানুষটিকে নিমগ্ন থাকতে দিয়েছিলেন নিজস্ব সাধনায়। পরম মমতায়। পরম ভালোবাসায়। হতে দিয়েছিলেন উলম্ব উন্মার্গগামী।

আর সেই বাড়ি থেকে আমি ধার করে নিয়ে এসেছি একটু বোধ। সেই বোধ নিজের করে নিতে পারলে হয়ত একদিন আমিও লেখক হব।

‘কী পাবে? সাঁতার দাও, দর্পণে, লাফিয়ে পড়ো জলে।’ 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

প্রথম ব্লগ সংখ্যা স ম্পা দ কী য় আবহমান একটি  ষান্মাসিক কাগজ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং দার্শনিক সন্দর্ভের। আমাদের মূল উদ্দেশ্যঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মিশেলে যে সময়খণ্ড আমাদের চালনা করে যাচ্ছে, তাকে অনুধাবন করা। কারণ সমকালীনতার আধার ছাড়া চিরকালীনতার আধেয়কে ধরা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আর ঠিক এ কারণেই শাশ্বত লুকিয়ে থাকে ক্ষণিকের মধ্যেই। কারণ আমাদের জীবন ক্ষণিকের ঘেরাটোপে চিরকাল অনন্তসন্ধানী। চেতনাকে চৈতন্যসন্ধানী করে তোলার জন্য এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। আর তার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল, বর্তমানে টুকরো টুকরো বোধিগুলোকে চয়ন করা। বর্তমান সময়খন্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তরুণ প্রজন্ম। সেই তরুণদের হাতে, ভাবনায়, কথনে এবং সৃষ্টিতে রচিত হয়ে চলেছে,- যে আবহমান সময়খন্ডের মধ্য দিয়ে তারা চলেছেন,- সেই 'সময়'। সেই সময়কালকে অনুধাবন করতেই এই ব্লগজিন। দুই  বাংলার তরুণ এবং উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখকরা নিয়মিত লিখুন এখানে। কবিতা, ছোট ছোট গদ্য, বড় গদ্য- সব। মনে রাখবেন, আমাদের কোনো পার্টি নেই, কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। নতুন ভাবনা আর নতুন দর্শন তথা ডিস্কোর্সকে আমরা স্বাগত জানাই। একদিনে তো সময়টা

তাঁবু , মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ- নিয়ে আলোচনা- আলোচনায় বেবী সাউ

আলোচনা বে বী  সা উ তাঁবু মই আর আমি    একজন সাধক বসে আছেন। নদী এসে ধুয়ে দিচ্ছে         সবুজ রঙ। শান্ত অথচ শান্ত না। ভুল নয় অথচ         ঠিকও না।  নক্ষত্রের পতনের শব্দ শুনতে পাইনি বলে     একা বসে আছে বিষাদের মেঘ। বিষাদের! আনন্দের       তবে। আনন্দম্। ঘন সবুজ সঙ্কেত পেরিয়ে নীল           অসীম ছুঁতে চাওয়া এই আমি কী আমিই! নাকি           জীবনের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে তারা খসার গল্প।           রূপকথার রূপকে উঠে আসছেন ঠাকুমা। কথক           হিসেবে  তিনিই তখন আমাদের ভাগ্য বিধাতা। রাজপুত্রের জন্ম মৃত্যুর জীওনকাঠি মরণকাঠি যেন তাঁর হাতে। ইচ্ছে করলেই যেন তিন জীবনদান করতে পারেন আমাদের প্রিয় বীর রাজপুত্তুরকে আবার তাঁর ইচ্ছেতে থেমে আছে রাক্ষসের জন্মমৃতশোক। কিন্তু একটাই ভয় সমস্ত জনম মৃত্যুর নিশানা ভেঙে যদি জেগে উঠেন কবি! যদি আমাদের সমস্ত রূপকথার মাঝে টেনে আনেন তাঁর নটে গাছের শব্দখেলা। তখন থেকেই আমার ভয় কবিদের এই রাজত্বে। ঠাকুমাও যেন গুটিগুটি বালিকা হয়ে কবিকে সঁপে দিচ্ছেন তাঁর সমস্ত সত্ত্বা। তাঁর গল্প কথনের ভঙ্গিমা। একমনে আউড়ে চলেছেন   ''আমার কথাটি ফুরাল নটে গাছটি মুড়াল কেন রে নটে মু

গিলগামেষের মহাকাব্য- লিখেছেন সুজন ভট্টাচার্য

প্রবন্ধ সু  জ  ন     ভ  ট্টা  চা  র্য গিলগামেষের   মহাকাব্য ছোটবেলা থেকে আমরা সবাইই শুনে আসি পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য হল রামায়ণ আর আদিকবি হলেন বাল্মিকী। সেই সাথে এটাও আমাদের জানা হয়ে যায়, পৃথিবীতে চারটি মহাকাব্য আছে। আমাদের রামায়ণ – মহাভারত বাদে অন্যদুটি হল গ্রীসের ইলিয়াদ এবং অদিসি। চারটির মধ্যে দুটিই কিনা আমাদের মাটিতে লেখা, ভাবলেই কেমন যেন গর্ব অনুভব হয়। সেই গর্বের আবহাওয়াকে আমরা  মননের জমিতে লালনপালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এস ওয়াজেদ আলি সেই যে লিখেছিলেন, “সেই ট্র‍্যাডিশন  সমানে চলিতেছে”, তার আলোকে আমাদের বুকও কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়ে ওঠে – দেখেছ, মুসলমান হলেও ঠিক স্বীকার করে নিয়েছে।  একটা বিষয়ে সকলেই একমত যে কোন মহাকাব্যই একজন কবির রচনা নয়। বিভিন্ন অনামা কবির কল্পনাতেই মহাকাব্যের প্রাথমিক কাঠামো নির্মিত হয়। এবং গানের মাধ্যমেই সেই রচনা জনসমাজে পরিব্যাপ্ত হয়। নানান সময়ে আরো বিভিন্ন কবি মূল কাঠামোর মধ্যে নিজস্ব শব্দ ঢুকিয়ে দেন। পরবর্তীকালে কোন একজন কবি সেগুলিকে সংকলন করেন এবং তাঁকেই মহাকাব্যের স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়। বাল্মিকীর রামায়ণে লবকুশের রামায়ণগানের উপাখ্যানে সম্ভবত সেই স