Skip to main content

গিলগামেষের মহাকাব্য- লিখেছেন সুজন ভট্টাচার্য

প্রবন্ধ

সু  জ  ন   ভ  ট্টা  চা  র্য


গিলগামেষের মহাকাব্য

ছোটবেলা থেকে আমরা সবাইই শুনে আসি পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য হল রামায়ণ আর আদিকবি হলেন বাল্মিকী। সেই সাথে এটাও আমাদের জানা হয়ে যায়, পৃথিবীতে চারটি মহাকাব্য আছে। আমাদের রামায়ণ – মহাভারত বাদে অন্যদুটি হল গ্রীসের ইলিয়াদ এবং অদিসি। চারটির মধ্যে দুটিই কিনা আমাদের মাটিতে লেখা, ভাবলেই কেমন যেন গর্ব অনুভব হয়। সেই গর্বের আবহাওয়াকে আমরা  মননের জমিতে লালনপালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এস ওয়াজেদ আলি সেই যে লিখেছিলেন, “সেই ট্র‍্যাডিশন  সমানে চলিতেছে”, তার আলোকে আমাদের বুকও কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়ে ওঠে – দেখেছ, মুসলমান হলেও ঠিক স্বীকার করে নিয়েছে। 

একটা বিষয়ে সকলেই একমত যে কোন মহাকাব্যই একজন কবির রচনা নয়। বিভিন্ন অনামা কবির কল্পনাতেই মহাকাব্যের প্রাথমিক কাঠামো নির্মিত হয়। এবং গানের মাধ্যমেই সেই রচনা জনসমাজে পরিব্যাপ্ত হয়। নানান সময়ে আরো বিভিন্ন কবি মূল কাঠামোর মধ্যে নিজস্ব শব্দ ঢুকিয়ে দেন। পরবর্তীকালে কোন একজন কবি সেগুলিকে সংকলন করেন এবং তাঁকেই মহাকাব্যের স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়। বাল্মিকীর রামায়ণে লবকুশের রামায়ণগানের উপাখ্যানে সম্ভবত সেই সত্যটাই লুকিয়ে আছে। 




পরবর্তীকালে গবেষকদের সিংহভাগ একমত হন যে পৃথিবীর আদিতম মহাকাব্য হল ইলিয়াদ, যা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে লিপিবদ্ধ হয়। অন্যদিকে রামায়ণ সংকলনের আনুমানিক সময় হল খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতক। যদিও অনেক ভারতীয় গবেষকই এই হিসাব মানেন না। তারা রামায়ণের রচনাকাল হিসাবে খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীকেই ধরেন। কে প্রথম, এই বিতর্ক আজো হয়তো অব্যাহত থাকতো, যদি না ইরাকে কতগুলো খোদাই করা পোড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হতো। 

১৮৫৩ সালে ইরাকি প্রত্নতত্ত্ববিদ হরমুজদ রসম ইরাকের মাসুল শহরের কাছে আসিরিয় সম্রাট আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারে পোড়ামাটির ফলকগুলো আবিষ্কার করেন। ফলকগুলির উপরে কীলকাকার বর্ণমালায় প্রাচীন সুমেরিয় ভাষায় খোদিত গিলগামেষ নামক এক রাজার কাহিনী। প্রাচীন সুমেরিয় লোকগাথা অনুযায়ী গিলগামেষ ছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ২১০০ অব্দে উরুকের তৃতীয় উর রাজবংশের সন্তান। রসম আবিষ্কৃত পোড়ামাটির ফলকগুলো খ্রীষ্টপূর্ব ১৮ শতাব্দীর নির্মাণ বলে দেখা যায়। প্রায় কোন ফলকই সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি। এটিকেই গিলগামেষের মহাকাব্যের প্রাচীন আক্কাদিয় বিবরণ বলে ধরা হয়। 



পরবর্তীকালে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর নবীন ফলকগুলি পাওয়া যায়। প্রাচীন ফলকে মহাকাব্যের নাম “সকল রাজাকে অতিক্রম করে”। আর নবীন ফলকে নাম হলো “যিনি অজানাকে জেনেছিলেন”। গিলগামেষের মহাকাব্যের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন জর্জ স্মিথ, ১৮৭০ সালে। এরপরে ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরো কিছু ফলক আবিষ্কৃত হয়, যাদের বিবরণ মূল ফলকের থেকে খানিকটা আলাদা। সবগুলোকে একত্রিত করে অ্যান্ড্রু জর্জ ২০০৩ সালে নতুন করে অনুবাদ করেন। এরপর ইউনেস্কো গিলগামেষের মহাকাব্যকে বিশ্বের প্রাপ্তব্য মহাকাব্যগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম বলে স্বীকৃতি দেয়।




নাম থেকেই বোঝা যায়, এই মহাকাব্যের নায়ক গিলগামেষ। যাবতীয় মহাকাব্যের নায়করাই আজন্ম ত্রুটিহীন, মহৎ। অথচ গিলগামেষের মহাকাব্যের সূচনাই হয় রাজা গিলগামেষের অত্যাচারের বিবরণ দিয়ে। গিলগামেষ স্বেচ্ছাচারী, উদ্ধত, কামুক। নিজের প্রয়োজনে কাউকেই রেয়াৎ করে না সে। প্রতিকার চেয়ে প্রজারা হাহাকার করে। সেই হাহাকারে দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। তারা সৃষ্টি করেন তার সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী এক, নাম এনকিদু। অরণ্যে পশুদের মধ্যেই এনকিদু তার আশ্রয় খুঁজে নেয়।




এনকিদুকে প্রথম দেখতে পায় এক শিকারী। সে সংবাদ পৌঁছে দেয় গিলগামেষের কাছে। গিলগামেষ শিকারীকেই দায়িত্ব দেয় এক লাস্যময়ী যুবতীকে ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে এনকিদুকে উরুকে নিয়ে আসার। যুবতীর শারীরি আবেদনে এনকিদু বাঁধা পড়ে যায়। নারীটির সহগমন করে সে চলে আসে উরুকে। এনকিদু স্পর্ধাভরে জানায় যাবতীয় রাজকীয় নিয়ম সে বদলে দেবে। গিলগামেষ আর এনকিদুর মধ্যে যুদ্ধ হয়। গিলগামেষ টের পায় এই প্রথম সে তার সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ পেয়েছে। শেষে রাজমাতা রিমাত-নিনসান এনকিদুকেও নিজের সন্তান বলে গ্রহণ করেন। গিলগামেষ আর এনকিদু পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে।



এরপর দুজনে মিলে হত্যা করে দেবদারুবনের ত্রাস হুমবাবাকে। দেবদারু বন থেকে কাঠ কেটে এনে উরুক নগরীকে সাজিয়ে তোলে। গিলগামেষের প্রতাপে মুগ্ধ হয়ে কামদেবী ইসথার প্রেম নিবেদন করে। এনকিদুর সাহচর্যে গিলগামেষ ইতিমধ্যে হয়ে উঠেছে নতুন মানুষ। তাই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আহত ইসথার দেবরাজ আনুর কাছে প্রতিকার চায়। ক্রুদ্ধ দেবরাজ স্বর্গের ষাঁড়কে পাঠিয়ে দেন গিলগামেষকে শাস্তি দেবার জন্য। কিন্তু গিলগামেষ আর এনকিদু মিলে সেই স্বর্গের ষাঁড়কেও হত্যা করে।



স্বর্গের ষাঁড়ের হত্যায় দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। তারা সিদ্ধান্ত নেন দুজনকেই শাস্তি দেবেন। সূর্যদেব শামাসের হস্তক্ষেপে সিদ্ধান্ত হয়, এনকিদুকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই সিদ্ধান্তে এনকিদুর মনে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দুজনে মিলে যে কাজ তারা করেছে, একা তাকেই কেন তার দায় বহন করতে হবে! নিজেকে সে প্রতারিত মনে করতে শুরু করে এবং এমনকি গিলগামেষকেও দোষারোপ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত উপবাসে এনকিদুর মৃত্যু হয়।

এনকিদুর মৃত্যুতে গিলগামেষ দু:খে ভেঙে পড়ে। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সে একাই ঘুরে বেড়াতে থাকে অরণ্যে, পর্বতে। রাজবস্ত্রের পরিবর্তে তার গায়ে ওঠে সিংহচর্ম। আর একদিন তার মনেও জেগে ওঠে মৃত্যুভয়। গিলগামেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, মৃত্যুর থাবা থেকে কিভাবে নিজেকে চিরতরে সুরক্ষিত রাখা যাবে, সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য সে যাবে উতানাপিস্তির কাছে। মহাপ্লাবনের সাক্ষী তিনি, একমাত্র তিনিই জীবিত ছিলেন সেই ভয়াল প্লাবনের শেষে।

একের পর এক সমুদ্র পার করে গিলগামেষ উপস্থিত হল উতানাপিস্তির কাছে। তার কাছে জানতে চাইল অমর হবার রহস্যবিদ্যা। উতানাপিস্তি বললেন, মৃত্যু জীবনেরই আরেকটি রূপ। অনিবার্য সে। আর মৃত্যু আছে বলেই জীবন এত সৌন্দর্যময়। মৃত্যু না থাকলে মানুষ জীবনের মহত্ত্ব বুঝতেই পারত না। মানুষ অমর হয় মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়; জীবনে তার যা অর্জন তার জন্যই। প্রজ্ঞায় উপনীত গিলগামেষ ফিরে আসে উরুকে, আবার নতুন করে জীবনচর্যা শুরু করবে বলে।

মৃত্যুভয় চিরন্তন। আর গিলগামেষের মহাকাব্যের মূল সুর সেই মৃত্যুভয়কে কেন্দ্র করেই। এটি একমাত্র মহাকাব্য যা মানুষের সেই অনাদিকালের আশঙ্কাকেই ধারণ করে রেখেছে। আর এভাবেই গিলগামেষের মহাকাব্য হয়ে উঠেছে কালজয়ী। 


Comments

Popular posts from this blog

প্রথম ব্লগ সংখ্যা স ম্পা দ কী য় আবহমান একটি  ষান্মাসিক কাগজ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং দার্শনিক সন্দর্ভের। আমাদের মূল উদ্দেশ্যঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মিশেলে যে সময়খণ্ড আমাদের চালনা করে যাচ্ছে, তাকে অনুধাবন করা। কারণ সমকালীনতার আধার ছাড়া চিরকালীনতার আধেয়কে ধরা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আর ঠিক এ কারণেই শাশ্বত লুকিয়ে থাকে ক্ষণিকের মধ্যেই। কারণ আমাদের জীবন ক্ষণিকের ঘেরাটোপে চিরকাল অনন্তসন্ধানী। চেতনাকে চৈতন্যসন্ধানী করে তোলার জন্য এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। আর তার জন্য যা প্রয়োজন, তা হল, বর্তমানে টুকরো টুকরো বোধিগুলোকে চয়ন করা। বর্তমান সময়খন্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তরুণ প্রজন্ম। সেই তরুণদের হাতে, ভাবনায়, কথনে এবং সৃষ্টিতে রচিত হয়ে চলেছে,- যে আবহমান সময়খন্ডের মধ্য দিয়ে তারা চলেছেন,- সেই 'সময়'। সেই সময়কালকে অনুধাবন করতেই এই ব্লগজিন। দুই  বাংলার তরুণ এবং উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখকরা নিয়মিত লিখুন এখানে। কবিতা, ছোট ছোট গদ্য, বড় গদ্য- সব। মনে রাখবেন, আমাদের কোনো পার্টি নেই, কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। নতুন ভাবনা আর নতুন দর্শন তথা ডিস্কোর্সকে আমরা স্বাগত জানাই। একদিনে তো সময়টা

তাঁবু , মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ- নিয়ে আলোচনা- আলোচনায় বেবী সাউ

আলোচনা বে বী  সা উ তাঁবু মই আর আমি    একজন সাধক বসে আছেন। নদী এসে ধুয়ে দিচ্ছে         সবুজ রঙ। শান্ত অথচ শান্ত না। ভুল নয় অথচ         ঠিকও না।  নক্ষত্রের পতনের শব্দ শুনতে পাইনি বলে     একা বসে আছে বিষাদের মেঘ। বিষাদের! আনন্দের       তবে। আনন্দম্। ঘন সবুজ সঙ্কেত পেরিয়ে নীল           অসীম ছুঁতে চাওয়া এই আমি কী আমিই! নাকি           জীবনের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে তারা খসার গল্প।           রূপকথার রূপকে উঠে আসছেন ঠাকুমা। কথক           হিসেবে  তিনিই তখন আমাদের ভাগ্য বিধাতা। রাজপুত্রের জন্ম মৃত্যুর জীওনকাঠি মরণকাঠি যেন তাঁর হাতে। ইচ্ছে করলেই যেন তিন জীবনদান করতে পারেন আমাদের প্রিয় বীর রাজপুত্তুরকে আবার তাঁর ইচ্ছেতে থেমে আছে রাক্ষসের জন্মমৃতশোক। কিন্তু একটাই ভয় সমস্ত জনম মৃত্যুর নিশানা ভেঙে যদি জেগে উঠেন কবি! যদি আমাদের সমস্ত রূপকথার মাঝে টেনে আনেন তাঁর নটে গাছের শব্দখেলা। তখন থেকেই আমার ভয় কবিদের এই রাজত্বে। ঠাকুমাও যেন গুটিগুটি বালিকা হয়ে কবিকে সঁপে দিচ্ছেন তাঁর সমস্ত সত্ত্বা। তাঁর গল্প কথনের ভঙ্গিমা। একমনে আউড়ে চলেছেন   ''আমার কথাটি ফুরাল নটে গাছটি মুড়াল কেন রে নটে মু